সাহিত্যে নোবেল-পুরস্কার প্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর কবি হিসেবে জনমননন্দিত হলেন। রবীন্দ্রপ্রতিভার এই পরিচয় সেদিন পাশ্চাত্যকে বিস্ময়ে হতবাক এবং অভিভূত করেছিল। সমগ্র পাশ্চাত্যজগৎ রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে সেদিন পৃথিবীর মানুষের মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল।
যথার্থই রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ থেকেই তার রচনার উপাদান সংগ্রহ করেছেন যা তাকে বিশ্বকবির মর্যাদা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ জন্মসূত্রে পশ্চিমবাংলার জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলা থেকেই কবিপ্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিমাত্রেই অনুভূতিপ্রবণ। রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রমী ছিলেন না। আর সে সময়ের অনুভূতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে তার নিজেরই বক্তব্যে। কবি বলেছেন, ‘বাল্যকালে দিন কেটেছে শহরে খাঁচার মধ্যে, বাড়ির মধ্যে। শহরবাসীর মধ্যেও ঘুরে ফিরে বেড়াবার যে স্বাধীনতা থাকে, আমার তাও ছিল না। একটা প্রকাণ্ড অট্টালিকার কোণের ঘরে ছিলাম বন্দী। সেই খোলা জানালা দিয়ে দেখেছি বাগান, সামনে পুকুর। লোকেরা স্নান করতে আসছে, স্নান সেরে ফিরে যাচ্ছে। পূর্বদিকে বটগাছ, ছায়া পড়েছে তার পশ্চিমে সূর্যোদয়ের সময়। বহির্জগতের এই স্বল্প পরিচয় আমার মধ্যে একটা সৌন্দর্যের আবেশ সৃষ্টি করত। জানালার ফাঁক দিয়ে যা আমার চোখে পড়ত তাতেই যেটুকু পেতুম তার চেয়ে যা পাইনি তাই বড় হয়ে উঠেছে কাঙ্গাল মনের মধ্যে। সেই না পাওয়ার একটা বেদনা ছিল বাংলার পল্লী গ্রামের দিগন্তের দিকে চেয়ে।’
রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ বছর ধরে যে সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন তার একটি নিজস্ব ভূগোল আছে। এই ভূগোলের একটি অংশ রাঢ় অঞ্চল, অর্থাৎ পশ্চিমবাংলা। এই অংশ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং এতদাঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের যে সাহিত্যকর্ম তার পরিমাণও স্বল্প। সেগুলো তার প্রতিভার স্বাক্ষরও তেমন বহন করে না। কারও মতে, ‘এতদাঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের যে সাহিত্যকর্ম তা অনেকটা আবদ্ধ জলাশয়ের মতো। এই ভূগোলের যে বিশাল অংশ তা অতীতের পূর্ববাংলা এবং বর্তমানের বাংলাদেশ।’
খুব ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ এই ভূখণ্ডের নাম শুনেছিলেন, শুনেছিলেন সে দেশের গান, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।’ তার মন সে দেশে যাওয়ার জন্য আকুলিত হতো। অবশেষে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে যখন তিনি সে দেশে এলেন তখন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হলো। তখন তার মনে হয়েছিল এ জগৎ যেন তার কত দিনের চেনা। এ জগতের বাঁশি তিনি শুনেছিলেন, কিন্তু এতকাল চোখে দেখেননি। এখানে এসেই তার হৃদয়ের অসংখ্য সূক্ষ্মতন্ত্রী যা এতকাল নীরব ছিল, জেগে উঠল প্রবলভাবে। যে প্রতিভা এতকাল অসহায়ভাবে হাতড়িয়ে যোগ্য আসনটা খুঁজে মরছিল, ভুল আসনে বসতে গিয়ে ভগ্নহৃদয়ের কথা লিখছিল, আঁকছিল সেই সব নর-নারী যারা কোনো নির্দিষ্ট দেশের অধিবাসী নয়। অন্ধ কল্পনারাজ্যের ছায়া-উপছায়া মাত্র।’
বাংলাদেশে এসেই সে প্রতিভা আপনার বাঞ্ছিত স্থানটি খুঁজে পেল। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি, ‘এ যেন কুজ্ঝটিকায় পথ হারানো পথিকের হঠাৎ আবিষ্কার করতে পারা যে, সে তার আপন ঘরের সামনে দণ্ডায়মান।’
প্রমথনাথ বিশী বাংলাদেশে রবীন্দ্র প্রতিভার এই অসামান্য এবং অভূতপূর্ব বিস্ফোরণের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘এ তাঁর জন্মস্থান নয়, এখানে এসে পৌঁছুতে তাঁর কিছু বিলম্ব হয়েছে- তাই তাঁর প্রতিভা স্ফুরণেও কিছু বিলম্ব!’
বাংলাদেশে এসেই রবীন্দ্রনাথ খুব যে বেশি লিখেছেন তা শুধু নয়, এখানকার রচনাবলির প্রকৃতি, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা সবই পূর্ববর্তীকালের রচনাবলি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এখানো আসার পর তার হৃদয়ে যে কল্পনা জেগেছিল তার স্বাক্ষর রয়েছে গল্পগুচ্ছের অর্ধশতাধিক গল্পে। এ ছাড়া তার অনেক ক্ষুদ্র গ্রন্থ ও প্রবন্ধে বাংলাদেশ অপরূপ সুসমায় বিকশিত হয়েছে। এখান থেকে ফিরে গিয়েও যেসব লেখা তিনি লিখেছেন, তার মধ্যেও তিনি বাংলাদেশকে বিবৃত করেছেন।
১৮৯১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কবির স্থায়ীভাবে বসবাসকালে তার প্রতিভার যে বিকাশ এবং ব্যাপ্তি ঘটেছিল তার ফলেই তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন এবং বিশ্বকবি হিসেবে নন্দিত হন। তার এই পৃথিবীর কবি হওয়ার মর্মমূলে বাংলাদেশের মাটি, মানুষ এবং প্রকৃতির অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি।
রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যকর্মের সব উপাদান সচেতনভাবে কিংবা কখনো কল্পনায় সংগ্রহ করেছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যকর্মের সোনার তরীতে ভরিয়ে তুলেছেন। তাই বাংলাদেশ যেমন রবীন্দ্রপ্রতিভার যোগ্যধাত্রী, তেমনি বাংলাদেশের জনগণও তার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে অতীতের সোনার বাংলাকে, দেখছে এক সূর্যোজ্জ্বল চারণভূমি, গবাদি পশু, গাঁয়ের রাখাল, হাতুড়ি-গাইতি চালানো মজুর-শ্রমিক, অভিমানী যুবতী কিংবা স্বামী-সোহাগিনী নারীকে। দেখছে সারা বাংলার মাঠ প্রান্তর ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিত্যপ্রবহমান শ্যামলী কন্যার মতো উজ্জ্বল পদ্মা নদীকে; দেখেছে, তার মোহনা কেবলই বিস্তৃত হয় এবং আপনাকে ছড়িয়ে দেয় মহৎ প্রশান্তি।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কর্মজীবনে তার সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশে অবস্থানকালেই অনেক বেশি সৃষ্টিশীল হয়েছিল। এখানে এসেই তিনি মানুষকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম হলেন। বাংলাদেশের বাউলেন গান এবং তাদের অকৃত্রিম সান্নিধ্য, ধর্ম ও জীবন সম্পর্কে তাকে এক নতুন দর্শন উপহার দিল। বর্ণবিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট জীবন থেকে দিল মুক্তির নির্দেশনা- উদার মানবতা। ‘দি রিলিজিয়ান অব ম্যান’¬-এ রবীন্দ্রনাথ তা বিধৃত করেছেন। প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশ তাকে যথার্থ কবি হিসেবে তৈরি করেছে। অতঃপর যেখানেই তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন, সেখানেই ফুটে উঠেছে আলোর কমল, আকাশভরা সূর্য¬-তারায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ছিন্নপত্রাবলী, কলিকাতা) চিঠিতে লিখেছেন: ‘...আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনও এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপর বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধমনে জলিবোটের উপর বিছানা পেতে পড়ে থাকতে পাবো। হয়তো আর কোন জন্মে এমন একটি সন্ধ্যাবেলা আর কখনও ফিরে পাবো না। তখন কোথায় দৃশ্য পরিবর্তন হবে- আর কি রকম মন নিয়েই বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি কিন্তু সে সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপর এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবো না। আমি কি ঠিক এমন মানুষটি তখন থাকবো!’
এখানে উল্লেখ করা অসংগত নয়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম পরিচয় শিলাইদহে। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে সেই যেবার তিনি তার প্রায় কুড়ি বছর বয়সে শিলাইদহে এসেছিলেন, তখুনি তিনি তার ভালোবাসার পাত্রীকে দেখেছিলেন। সেই তো তার প্রথম প্রেম, প্রথম কদম ফুল। ছিন্নপত্রের ষাটটিরও অধিক চিঠিতে শিলাইদহ, পদ্মা এবং গড়াইয়ের রূপবর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। হৃদয়ের এত কথা রবীন্দ্রনাথ অন্য কোনো স্থান সম্পর্কে আর বলেননি। বস্তুত, শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথের অণুবিশ্ব- তার প্রতিভা বিকাশের যোগ্যধাত্রী।
প্রমথনাথ বিশী (শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ৩২) লিখেছেন, স্পষ্টই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীর কবি হওয়ার মূলে শিলাইদহ এবং তার পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। এখানে এসেই রবীন্দ্রনাথ তার বিপুল মানবসংসারে প্রবেশের পথ পেলেন। দেখলেন, নদীতীরবর্তী জনপদের অগণিত সাধারণ মানুষ, তাদেরও সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না। এখানে এসেই রবীন্দ্রনাথের পূর্বেকার সব জীবনধারা পাল্টে গেল। তিনি এক অন্য রবীন্দ্রনাথে পরিণত হলেন- যিনি সাধারণ থেকে অসাধারণ। তিনি অনুভব করলেন, মাতৃভূমির যথার্থস্বরূপ গ্রামের মধ্যেই, এখানেই প্রাণের নিকেতন। পদ্মা নদীর ধারে বসেই কবি উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনো ধর্মগত ও বর্ণগত বৈষম্য নেই, সেটা শুধু মানষেরই জাগতিক স্বার্থে রচিত। মানবাত্মার মধ্যদিয়ে পরমাত্মারস্বরূপ অনুভব করা যায়। দেবতা, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জার মধ্যে নেই, আছেন মানুষের মধ্যে, তার জীবনের সাধনার মধ্যে।
লেখক: বাউল ও রবীন্দ্র গবেষক
মন্তব্য করুন