ঢাকা শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

চেতনায় বেঁচে থাকুক কবিগুরু

ড. সুচরিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৫, ০৩:০৫ পিএম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পঁচিশে বৈশাখ এলেই সভায় কাগজে বাজে ঢাকঢোল- কারও বা ঝুমঝুমি আর তার পরই এ বড়ো অদ্ভুত রাজ্য ছাব্বিশে বৈশাখে মরুভূমি! বিষ্ণু দে-র লেখা এ কবিতার পর পেরিয়ে গেছে ছেষট্টি বছর। তাই এখন আর বলা যাবে না যে ছাব্বিশে বৈশাখেই সব মরুভূমি হয়ে যায়, বরং এখন এই ঝুমঝুমি চলতে থাকে প্রায় পক্ষাধিক কালজুড়ে, মরুভূমি আসে হয়তো আর একটু পরে। অথচ যাকে ঘিরে এত আয়োজন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, কখনো যদি তাকে মনে করতে ইচ্ছে হয়, তবে চৈত্রের শালবনে এসে বসতে। ২০২৫-এর পঁচিশে বৈশাখের হুজুগসর্বস্বতায় ক্লান্ত হয়ে আর ছাব্বিশে বৈশাখ-উত্তর সেই মরুভূমি-তে দাঁড়িয়ে আমাদের কারও মনে হতে পারে রবিশস্য দগ্ধস্তূপ ঈশানী প্রস্তুতিহীনা দীনা।

তবু প্রশ্ন ওঠে- সবই কি একেবারে দগ্ধস্তূপ? হয়তো ততটাই নয়। এসব সভায় কাগজে নানা কথার তুচ্ছ উচ্চারণের মধ্যেও হয়তো অল্পে কোথাও সঞ্চারিত হয়ে যায় কোনো গানের এটা নতুন বোধ, হয়তো কোনো কবিতার নতুন উদ্ভাসন, না-দেখা না-জানা কোনো কাজের চকিত আবিষ্কার। এই হুজুগে সময়কে উপলক্ষ করে হয়তো কেউ তার অসমাপ্ত লেখা নিয়ে বসেন আরও একবার, তার সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন আরও একটু। আমাদের চৈতন্যে তার যে কোনোই তাৎপর্য থাকে না, এমনটা নয়।

রবীন্দ্র সৃষ্টিজুড়ে যেমন আছে তার কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-ছবি, অন্যদিকে তেমনি এক-একটা জীবনকেও তো তিনি সৃষ্টি করে তোলেন তার অগোচরে। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই, কারণ রঙে-রেখায়-শব্দে-সুরে তিনি তো গড়ে তোলেন জীবনেরই একটা বোধ, আর সেই বোধই আমাদের মধ্যে তো পৌঁছে দেয় কোনো শিল্পের যথার্থ অভিজ্ঞতা। সেই শিল্প পূর্ণতা পায় তখনই, যখন সেই শিল্পজাত বোধ পৌঁছয় আমাদের সত্তায়, জীবনদৃষ্টিতে, আমাদের দৈনন্দিন যাপনে। তাই রবীন্দ্রনাথ তার পাঠককে ডেকেছিলেন শালবনে, কারণ সেখানে শাখায় শাখায় মঞ্জরি বা পাখিকে ডেকে এনেছে যে আদিম সমীরণ, যে কাল, সেই একই কাল তো তাকেও ডেকেছিল: আমারে সে ডেকেছিল কভু খনে খনে/ রক্তে বাজায়েছিল তার তাল।

আমরা কি ওইরকম বলতে পারি কখনো? বলতে হয়তো পারব যদি কেবল এই পুঁথিগত রবীন্দ্রচর্চা ছেড়ে রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের ভিতরে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। সেটা সম্ভব জীবনের প্রতি ভালোবাসায়, মানুষের জন্য মমতায় আর সখ্যের বোধে। এমন দুয়েকজন মানুষ আছেন আজও, ছিলেনও দুয়েকজন; যাদের আন্তরিক স্নেহে আর উদ্যত সহায়তায় সমৃদ্ধ হই আমরা। তাদের কাছে গিয়ে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের আবহে ভরে ওঠে শরীর-মন। ছাব্বিশে বৈশাখে সব মরুভূমি হয়ে গেলেও এই শহরে একটি মরূদ্যান ছিল উল্টোডাঙ্গায়। যেখানে অতীতের অনেক অজানা কথার টুকরো উদ্ঘাটনের সঙ্গেই ভবিষ্যতের স্বপ্নরচনাও থাকত অব্যাহত, তিনি আমাদের মাস্টার মশাই শঙ্খ ঘোষ। তার কাছে গিয়ে দুদণ্ড বসতে পারলে মনে হতো একজন মানুষের গোটা জীবনের মধ্যে সব সময়েই জেগে আছে পঁচিশে বৈশাখ। মরুভূমির কথা ভেবে ভেবে যখন আমরা ক্লান্ত, তখন ভরসা করতে ইচ্ছে হয় এমন মরূদ্যানে; যা হয়তো আমাদেরই আশপাশে, আমাদের অজ্ঞাতসারে, কোথাও থেকে গেছে। ঝুমঝুমির প্রবলতায় যার খোঁজ পাই না সহজে আমরা, শুধু মনে হয়: আছে, আছে, কিছু নিশ্চয়ই আছে আজও কোথাও। সেই অন্বেষণই হোক আমাদের ব্রত, এই পঁচিশে বৈশাখে।

নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এই আত্মকেন্দ্রিকের সমাজে, জীবনকে মুহুর্মুহু পণ্য করে দেওয়া এই সমাজে, কীভাবে কেউ বারবার আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারেন আমাদেরই এই আত্মমর্যাদার কথা। মানবতার সেই গর্বটুকুই শুধু ভেবে দেখার দিন এসেছে আজ। অনায়াস কোনো পথ নেই এ মানবতার। আমাদের চারপাশে কেবলই ছড়ানো দেখি মনন আর আবেগের বিরোধ, চৈতন্য আর শ্রমের বিরোধ, দেশ আর কালের বিরোধ। এর কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়ে কাজটাকে কিছু সহজ করে নিতে চাই আমরা। অধীর হয়ে ভাবি- যে মুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয়, আর সেই জন্য আকস্মিক নৈরাশ্যেও ভেঙে পড়ি অনেক সময়ে। এ প্রবণতা থেকে নিজেদের বার করে নেওয়া অনেক সাধনার কাজ। মধ্যবর্তী সামঞ্জস্যের পথটি চেনা সহজ, তবে সে পথ খুঁজে নেওয়া আর তাতেই শামিল হওয়া কঠিন, কারণ বন্ধুরা অনেকেই ছেড়ে যায় পথের মাঝখানে। তবু সেই কঠিন পথে তো তিনি চলেছিলেন। মানুষ যে মরিয়া আবেগে বাঁচতে চায় তার দৈনন্দিনে, তার ইতিহাসে, এরই ব্যথাবেদনার গর্ব-উল্লাসের আনন্দ-সংকটের সব ছবি নিয়ে গোটা পৃথিবীর জীবনকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন যে কবি, তার না থাকাতেও সেই মানুষের পৃথিবীটাই উঠে আসে আমাদের সামনে।

উঠে আসে, আর মনে হয়, এই সেই প্রেমের পৃথিবী, বিদায় নেওয়ার আগে যার সামনে দামিনীর মনে হয়েছিল, মিটিল না সাধ, আর পরবর্তী কালের কবি বিষ্ণু দে-র মনে হয়েছিল ওই দামিনীকে ঘিরে, আমারও মেটে না সাধ, তোমার সমুদ্রে যেন মরি। কবির আবেগে তখন একাকার মিলে গিয়েছিল প্রেম আর প্রকৃতি আর শিল্প, দামিনী যখন হয়ে উঠেছিল গোটা জীবনযাপনের প্রতীকী ছবি। আর আজ এই সৌন্দর্য-অবসিত বিড়ম্বিত জীবনে আমাদের মনে হয়, সমুদ্রে দীপ্র তোমার শরীরে শুধু দামিনীর বা প্রকৃতিরই পরিচয় নয়, এ বর্ণনা কবির রচনা-বিশ্বেরই এক অভ্রান্ত পরিচয়; যার সামনে দাঁড়িয়ে আজকের পাঠক বলতে চাইবেন, শুনতে চাইবেন বারবার: আমারও মেটে না সাধ, তোমার সমুদ্রে যেন মরি

রবীন্দ্রনাথ থেকে তার উত্তরসাধকের সৃষ্টি মিলিয়ে নিলে আজ এই ২০২৫-এর ২৫শে বৈশাখে ঠিকই বুঝতে পারব তাদের সৃষ্টির মধ্যেই তাদের স্রষ্টাচরিত্রের অনেক ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। রবীন্দ্রসৃষ্টির নেপথ্যে যে নির্জনতা ছিল, সেই নির্জনতায় বাইরের দেখা বা ঘরের জানা জগৎকে মন দিয়ে তিনি দেখেশুনে বুঝে নিতে চেয়েছিলেন, পেরেছিলেন। এই বুঝে নিতে চাওয়া থেকে শেষ বয়সেও নিজেকে নিবৃত্ত রাখেননি তিনি। শেষ কটা বছরজুড়ে কবি তার স্মৃতিমথিত দিনগুলোকেই দেখেছিলেন ফিরে। যেমন আমরাও দেখি শেষবেলায় ফেলে আসা দিন-কাল। আর তাই আজ এই প্রতিজ্ঞা নিক মানুষ, যেন নিজেদেরই সেই স্মৃতিচারণে জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর সত্যতা-সৌন্দর্য-মাধুর্যই ধরা পড়ে। আজ এই স্মৃতিমুহূর্তে কবি অজিত দত্তের একটি কবিতার ভাষায় শেষ কথাটুকু বলতে পারি-

তবু যদি তুমি কোনোদিন এখানে আসো,

যদি এসে পৌঁছও,

তবে হয়তো তুমি দেখবে যে,

এই নিষ্ঠুর অন্ধকার, এই প্রবঞ্চক অন্ধকার,

তোমার জন্য সঞ্চয় করে রেখেছে

একটুখানি করুণা, একটু সান্ত্বনার কণা।

লেখক: অধ্যাপক, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০