ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১১ আগস্ট ১৯৭১: লন্ডনের হাইড পার্কে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিবাদ

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৫, ০৬:০৫ পিএম
১১ আগস্ট ১৯৭১: লন্ডনের হাইড পার্কে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিবাদ

১১ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং এর আন্তর্জাতিক প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল লন্ডনের হাইড পার্কে প্রবাসী বাঙালিদের একটি বিক্ষোভ সমাবেশ, কূটনৈতিক বিদ্রোহ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের একটি সিদ্ধান্তের প্রতি দুঃখ প্রকাশ, এবং করাচিতে চীন ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি তৎকালীন বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রতিফলন ঘটায়। এই প্রতিবেদনে এই ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো, যা এই সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে তাদের তাৎপর্যকে একত্রিত করে।

লন্ডনে প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি সংহতি প্রকাশের এক শক্তিশালী প্রদর্শন হিসেবে, লন্ডনের হাইড পার্কে প্রবাসী বাঙালিরা একটি বিক্ষোভ সমাবেশে মিলিত হয়। এই সমাবেশের উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের নেতা এবং বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকে “প্রহসন” হিসেবে আখ্যায়িত করে এর প্রতিবাদ জানানো। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অধীনে পরিচালিত এই বিচারকে ব্যাপকভাবে ন্যায়বিচারের উপহাস হিসেবে সমালোচিত করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করা। হাইড পার্কের এই সমাবেশ শুধু একটি প্রতিবাদই ছিল না, বরং পাকিস্তান সরকারের এই মঞ্চস্থ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভের প্রকাশ ছিল।

এই সমাবেশের তাৎপর্য আরও বৃদ্ধি পায় একটি নাটকীয় ঘোষণার মাধ্যমে। পাকিস্তান সরকারের অধীনে কর্মরত চারজন বাঙালি কূটনীতিক এবং কর্মচারী এই সমাবেশে পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য ত্যাগের ঘোষণা দেন। এই বিদ্রোহের কাজটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি সাহসী সমর্থন। এই চার ব্যক্তির পরিচয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি, তবে তাদের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান বিভক্তি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থনের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্রমবর্ধমান গতিকে তুলে ধরে এবং প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই আন্দোলনের গভীর প্রভাবকে প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিক্রিয়া

একই দিনে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইসলামাবাদ এবং ঢাকায় ভ্রমণের অনুমতি না দেওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। সিনেটর কেনেডি, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার সমালোচনা করেছিলেন, তিনি এই অঞ্চলে পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে তদন্ত এবং সমালোচনা এড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এই দুঃখ প্রকাশ পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডের প্রতি ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়। এটি এও প্রকাশ করে যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসন তাদের অভ্যন্তরীণ নীতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সহিংসতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ এড়াতে চাইছিল। সিনেটর কেনেডির মতো একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে প্রবেশাধিকার না দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের ক্রিয়াকলাপের স্বচ্ছতার অভাব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের সম্ভাব্য প্রভাবকে তুলে ধরে।

করাচিতে চীন-পাকিস্তান বৈঠক

একই সময়ে, করাচিতে চীনা কনস্যুলেটের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। ৯ আগস্ট ১৯৭১-এ স্বাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল, কারণ এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সমর্থনকে আরও শক্তিশালী করেছিল। চীন, যিনি পাকিস্তানের একটি ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন, এই চুক্তির প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ এটি দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারত।

ভুট্টোর সঙ্গে চীনা প্রতিনিধির এই বৈঠক পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য চীনের সহায়তা নিশ্চিত করার প্রয়াসকে নির্দেশ করে। এই আলোচনা পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহের প্রচেষ্টা এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করেছিল। এই বৈঠকটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্তর্জাতিক মাত্রাকে আরও স্পষ্ট করে, যেখানে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা এই সংঘাতের গতিপথকে প্রভাবিত করছিল।

ঘটনাগুলোর তাৎপর্য

১১ আগস্ট ১৯৭১-এর এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বহুমাত্রিক প্রকৃতি এবং এর বৈশ্বিক প্রভাবকে তুলে ধরে। লন্ডনের হাইড পার্কে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিবাদ এবং চারজন কূটনীতিক ও কর্মচারীর বিদ্রোহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভক্তির প্রমাণ। এটি প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা এবং তাদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অবদানের গুরুত্বকে প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুঃখ প্রকাশ পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডের প্রতি আন্তর্জাতিক সমালোচনার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে নির্দেশ করে। সিনেটর কেনেডির মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রবেশাধিকারে বাধা সৃষ্টি করা পাকিস্তানের সামরিক শাসনের স্বচ্ছতার অভাব এবং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত এড়ানোর প্রচেষ্টাকে প্রকাশ করে। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের সম্ভাব্য প্রভাবকেও তুলে ধরে।

করাচিতে চীন-পাকিস্তান বৈঠকটি এই সংঘাতের ভূ-রাজনৈতিক মাত্রাকে স্পষ্ট করে। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তান তাদের মিত্র চীনের সমর্থন নিশ্চিত করতে চেয়েছিল, যা এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপথকে প্রভাবিত করেছিল। এই ঘটনাগুলো একত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের জটিলতা এবং এর বৈশ্বিক প্রভাবকে প্রকাশ করে।

১১ আগস্ট ১৯৭১-এর ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে চিহ্নিত করে। লন্ডনের প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিভক্তির প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া এবং চীন-পাকিস্তান বৈঠক এই সংঘাতের আন্তর্জাতিক মাত্রাকে তুলে ধরে, যেখানে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা এই যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করছিল। এই ঘটনাগুলো একত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বৈশ্বিক তাৎপর্য এবং এর জন্য প্রবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবদানকে প্রকাশ করে।

সূত্র:

- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও এগারো

- দৈনিক পাকিস্তান, ১২ ও ১৩ আগস্ট ১৯৭১

- আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১২ ও ১৩ আগস্ট ১৯৭১

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১০

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১১

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১২

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৩

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৪

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৫

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৬

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৭

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৮

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৯

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

২০