ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১০ আগস্ট ১৯৭১: রাজাকারদের চতুলবাজার ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনীর অভিযান

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১০:৪৭ এএম
১০ আগস্ট ১৯৭১: রাজাকারদের চতুলবাজার ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনীর অভিযান

১০ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে কূটনৈতিক আলোচনা, সামরিক অভিযান, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের গতিপথে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে। এই প্রতিবেদনে ১০ আগস্টের ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা একাধিক সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে।

দিল্লিতে কূটনৈতিক বৈঠক

ইন্দিরা গান্ধী ও আঁদ্রে গ্রোমিকোর বৈঠক

১০ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলমান সংকট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল শরণার্থী সংকট, পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার, এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিরসন। এই বৈঠক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরদার করতে এবং মানবিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আঁদ্রে গ্রোমিকো ইন্দিরা গান্ধীকে জানান, সোভিয়েত ইউনিয়ন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই বিচার চলতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। শেখ মুজিব জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতা, তাই তাকে নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত। শরণার্থী সমস্যা একটি জটিল বিষয়, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করবে। আমরা সবসময় ভারতের পাশে ছিলাম এবং থাকব।”

ইন্দিরা গান্ধী জবাবে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের মুখোমুখি করা মানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির উপর প্রতিহিংসার আক্রমণ। তাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছে। পাকিস্তান সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার নাটক সাজিয়েছে, কিন্তু পূর্ব বাংলা এখনো নিরাপদ নয়। গণহত্যা ও নির্যাতনের কারণে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, অথচ পাকিস্তান ভারতকে দোষারোপ করছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে মিথ্যাচার করছে।” এই বৈঠক ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঐক্য জোরদার করে এবং পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি ও শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় একমত হয়।

ভারতে ঘটনাবলি

ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি

এই দিনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম রাজ্যসভায় প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সামনে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, “দেশের নিরাপত্তার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সর্বদা প্রস্তুত। তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত। আমাদের নৌবাহিনীকেও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়েছে। পাকিস্তান যদি আমাদের উপর হামলা চালায়, তবে তার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে।” এই বক্তব্য ভারতের সামরিক প্রস্তুতি এবং পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনার মধ্যে দেশের অবস্থান স্পষ্ট করে।

দিল্লিতে বিক্ষোভ

বাংলাদেশের প্রতি সংহতি প্রকাশে দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে অন্ধ্র প্রদেশের ২০টি উর্দু পত্রিকার সম্পাদকরা প্রখ্যাত সম্পাদক আলী সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন। তারা পাকিস্তানের গণহত্যা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রতিবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা পোড়ান। তারা হাইকমিশনে একটি প্রতিবাদ স্মারকলিপি জমা দিতে গেলে কর্মকর্তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তারা স্মারকলিপিটি ভবনে ছুঁড়ে দেন। পরে তারা মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করেন।

পাকিস্তানে ঘটনাবলি

এডওয়ার্ড কেনেডির সফর বাতিল

১০ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ১২ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া পূর্ব পাকিস্তান সফর বাতিল করে। কেনেডি শরণার্থী বিষয়ক সিনেট উপকমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার নির্ধারিত বৈঠকও বাতিল করা হয়। এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের শরণার্থী সংকট এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক তদন্ত এড়ানোর প্রচেষ্টাকে প্রকাশ করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এডওয়ার্ড কেনেডির ভারত সফর

১০ আগস্ট মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি শরণার্থীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কলকাতায় আসেন। বিমানবন্দরে অবতরণের পর তিনি বয়রা সীমান্তে যান এবং দুটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত বাঙালির দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে তিনি কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “দেশে ফিরে আমরা শরণার্থীদের সুরক্ষা এবং তাদের দ্রুত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য পদক্ষেপ নেব।”

জাতিসংঘে আলোচনা

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি, শরণার্থী সংকট, এবং ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে চার ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করেন। এই বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ ডব্লিউ বুশ উপস্থিত ছিলেন। একই দিনে জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র উ থান্টের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ক্ষতি হলে তার প্রভাব পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া

মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একটি বিবৃতিতে বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার কোনো চেষ্টা করা হলে এই অঞ্চল অগ্ন্যুৎপাতের মুখোমুখি হবে।” তিনি সভ্যতা, গণতন্ত্র, মানবতা, এবং ন্যায়বিচারের নামে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের নিঃশর্ত মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশে সামরিক ও প্রতিরোধ কার্যক্রম

গেরিলা অভিযান

১০ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালনা করে। মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিমের আবদুল্লাহপুরে শান্তি কমিটির একটি সমাবেশে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা গুলি চালায়। এতে পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য মাওলানা মাহমুদ মোস্তফা আল মাদানী নিহত হন। তিনি তখন বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা দিচ্ছিলেন এবং স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের নির্মূলের জন্য তার দলের কর্মীদের উৎসাহিত করছিলেন।

শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে হামলা

সিলেটে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে পাঁচ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানে অতর্কিত হামলা চালায়। প্রায় দুই ঘণ্টার যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী স্টেশনের একটি বড় অংশ দখল করে এবং পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তবে পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা আর্টিলারি হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ইপিআরের হাবিলদার কুতুব, নায়েক মান্নান, এবং মুজাহিদ হাবিলদার মোহাম্মদ ফয়েজসহ ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং পাঁচজন আহত হন। মুক্তিবাহিনী এই অভিযানে প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করে।

কানাইঘাটে অভিযান

সিলেটের কানাইঘাটের ৪ নম্বর সেক্টরের ডাউকি সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাজাকারদের চতুলবাজার ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই হামলায় তিনজন রাজাকার ধরা পড়ে এবং দুজন নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়।

অন্যান্য অভিযান

শালদা নদীর পশ্চিমে ক্যাপ্টেন সালেকের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লা সিএন্ডবি সড়কের কাছে শিদলাই গ্রামে একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। এছাড়া দিরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একজন রাজাকারের বাড়িতে হামলা চালায়।

১০ আগস্ট ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনাবহুল দিন ছিল, যেখানে কূটনৈতিক, সামরিক, এবং মানবিক কার্যক্রম একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে শক্তিশালী করে। ইন্দিরা গান্ধী ও আঁদ্রে গ্রোমিকোর বৈঠক, ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া, এবং মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান এই দিনের তাৎপর্যকে আরও গভীর করে। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি এবং শরণার্থী সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমবর্ধমান চাপ পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সমর্থন জোরদার করে।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১১ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ১১ ও ১২ আগস্ট ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১১ ও ১২ আগস্ট ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও তিন

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১০

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১১

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১২

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৩

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৪

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৫

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৬

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৭

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৮

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৯

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

২০