ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

কাথুলি-ভাটপাড়া কুঠি নির্যাতন কেন্দ্র | মেহেরপুর

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৫:৫৯ পিএম
কাথুলি-ভাটপাড়া কুঠি নির্যাতন কেন্দ্র | মেহেরপুর

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য একটি গৌরবময় অধ্যায়। তবে এই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংস গণহত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কাথুলি এবং ভাটপাড়া এলাকায় অবস্থিত ভাটপাড়া নীলকুঠি ছিল এমনই একটি নির্যাতন কেন্দ্র, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের দোসর পিস কমিটির সদস্য এবং রাজাকারদের সহায়তায় বেপরোয়া নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এই প্রতিবেদনে কাথুলি-ভাটপাড়া কুঠি নির্যাতন কেন্দ্রের ঐতিহাসিক পটভূমি, নির্যাতনের ধরন এবং এর প্রভাব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।

ঐতিহাসিক পটভূমি

ভাটপাড়া নীলকুঠি, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার সাহারবাটি ইউনিয়নে কাজলা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে এই নীলকুঠি নির্মিত হয়েছিল ইট, চুন-সুরকি এবং লোহার বীম ও ইটের টালি দিয়ে। এটি মূলত নীল চাষের জন্য ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ঐতিহাসিক কাঠামোটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে একটি ভয়াবহ নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গাংনী থানার সীমান্তবর্তী কাথুলি গ্রাম থেকে তাদের আস্তানা গুটিয়ে ভাটপাড়ার পরিত্যক্ত নীলকুঠিতে স্থানান্তরিত হয়। এই কুঠিটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি কাজলা নদীর তীরে অবস্থিত এবং সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য একটি নিরাপদ আস্তানা হিসেবে কাজ করত। পিস কমিটির সদস্য এবং রাজাকারদের সহযোগিতায় এই কুঠি একটি নির্যাতন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়, যেখানে অসংখ্য নিরীহ নারী-পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়।

নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ভাটপাড়া কুঠি

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার ও পিস কমিটির সদস্যরা ভাটপাড়া নীলকুঠিকে তাদের নৃশংস কার্যকলাপের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এই কুঠিতে নিয়ে আসা বন্দীদের উপর নানাবিধ নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতনের মধ্যে ছিল শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, এবং মানসিক অত্যাচার। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের পর বন্দীদের হত্যা করে তাদের মৃতদেহ কাজলা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। এই নদীটি নির্যাতন কেন্দ্রের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় মৃতদেহ নিষ্কাশনের জন্য একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

গাংনী বাজারে স্থাপিত পিস কমিটির অফিসটিও এই সময়ে একটি সহায়ক নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। পিস কমিটির সদস্যরা, যারা মূলত স্থানীয় সহযোগী এবং রাজাকারদের নিয়ে গঠিত, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সমর্থকদের চিহ্নিত করতে সহায়তা করত। তারা গ্রামের নিরীহ মানুষদের ধরে এনে ভাটপাড়া কুঠিতে পাঠাত, যেখানে তাদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো।

নির্যাতনের ধরন

ভাটপাড়া কুঠি নির্যাতন কেন্দ্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা বিভিন্ন ধরনের নৃশংস কার্যকলাপ চালাত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:

১. শারীরিক নির্যাতন: বন্দীদের উপর প্রহার, বিদ্যুৎ শক, এবং অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। অনেককে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং তাদের উপর লাঠি, রাইফেলের বাট, এবং অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হতো।

২. যৌন নির্যাতন: মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে গণধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। গবেষকদের মতে, ১৯৭১ সালে দুই থেকে চার লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ভাটপাড়া কুঠিতে গাংনী থানার অসংখ্য নারীকে ধরে এনে ধর্ষণ করা হতো। এই নির্যাতনের ফলে অনেক নারী গর্ভধারণ করেন, আত্মহত্যা করেন, বা সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার হন।

৩. হত্যাকাণ্ড: নির্যাতনের পর অনেক বন্দীকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ কাজলা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল সুপরিকল্পিত এবং মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সমর্থকদের দমন করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

৪. মানসিক অত্যাচার: বন্দীদের পরিবারের সদস্যদের সামনে নির্যাতন করা হতো, যাতে তাদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া, বন্দীদের দীর্ঘ সময় অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখা হতো, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলত।

পিস কমিটি ও রাজাকারদের ভূমিকা

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের দোসর হিসেবে স্থানীয় পিস কমিটি, রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস বাহিনী গঠন করে। গাংনী থানায় পিস কমিটির অফিস ছিল এই নির্যাতনযজ্ঞের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পিস কমিটির সদস্যরা এবং রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সমর্থকদের চিহ্নিত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিত। এই সহযোগীরা স্থানীয়ভাবে পরিচিত হওয়ায় তাদের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী সহজেই নিরীহ মানুষদের ধরে আনতে পারত।

পিস কমিটির সদস্যরা এবং রাজাকাররা শুধু তথ্য সরবরাহই করত না, বরং অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিত। তাদের এই ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।

নির্যাতনের প্রভাব

ভাটপাড়া কুঠি নির্যাতন কেন্দ্রে সংঘটিত অত্যাচারের ফলে গাংনী উপজেলার জনজীবনে গভীর প্রভাব পড়ে। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক নারী যৌন নির্যাতনের পর সামাজিক বয়কট ও লাঞ্ছনার শিকার হন। এছাড়া, হত্যাকাণ্ডের ফলে অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হারিয়ে অর্থনৈতিক ও মানসিক সংকটে পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা বাঙালি জাতির মধ্যে প্রতিরোধের চেতনাকে আরও জোরালো করে। গাংনী উপজেলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল এবং ভাটপাড়া কুঠির নির্যাতন তাদের সংগ্রামকে আরও দৃঢ় করেছিল।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে ভাটপাড়া নীলকুঠি একটি জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। অযত্ন ও সংস্কারের অভাবে এই ঐতিহাসিক কাঠামোটি ধ্বংসের পথে। তবে এটি এখনও ব্রিটিশ শাসনামলের নীলচাষের নির্যাতন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের নীরব সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকার এই কুঠিটিকে একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এখনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

কাথুলি-ভাটপাড়া কুঠি নির্যাতন কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই কুঠিতে সংঘটিত নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড গাংনী উপজেলার মানুষের জীবনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তবে এই অত্যাচারের মুখেও বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম অটুট ছিল। ভাটপাড়া নীলকুঠির ইতিহাস শুধু নির্যাতনেরই সাক্ষ্য বহন করে না, বরং বাঙালির প্রতিরোধ ও সাহসের গল্পও বলে। এই ঐতিহাসিক স্থানটি সংরক্ষণ করা এবং এর ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।

তথ্যসূত্র

  • মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড), মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

  • গাংনী উপজেলা ওয়েবসাইট,

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধর্ষণ, উইকিপিডিয়া,

  • প্রথম আলো, গণহত্যা ও বধ্যভূমি সংক্রান্ত প্রতিবেদন,

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১০

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১১

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১২

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৩

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৪

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৫

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৬

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৭

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৮

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৯

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

২০