১৯৭১ সালের ২৭ মে ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা ও বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের গভীরতা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার প্রমাণ মেলে। এ প্রতিবেদন সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে।
নয়াদিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ মে নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, পূর্ববাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের কারণে ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট চাপ পড়েছে। তিনি পাকিস্তান সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি মোকাবিলার পাকিস্তানের নীতি শুধু ভারতের নয়, গোটা অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত করছে।” ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক সমাজকে এই হুমকির বিষয়ে সজাগ হওয়ার আহ্বান জানান।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের একটি বক্তব্য প্রচারিত হয়, যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই বিবৃতিতে তারা পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আওয়ামী লীগ স্পষ্ট জানায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আর কোনো আপস সম্ভব নয়।
মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির বিবৃতি
মার্কিন সিনেটের শরণার্থী সংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ২৭ মে এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সমস্যা সমাধানে বিশ্বের সব দেশের এগিয়ে আসা উচিত।"
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী বলেন, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি ভারতের ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন এবং বলেন, “পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের নাক গলানো উচিত নয়।”
দ্য গার্ডিয়ানের চিঠি
২৭ মে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় কলকাতার সদর স্ট্রিট মেথোডিস্ট চার্চের দুই খ্রিষ্টধর্মীয় নেতা রেভারেন্ড জন হ্যাস্টিংস ও রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহামের চিঠি প্রকাশিত হয়। তারা চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ও নারকীয় নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন।
চিঠিতে বলা হয়, “আমরা শত শত শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা নিজের চোখে মেশিনগানের গুলিতে স্বজন হারানোর দৃশ্য দেখেছেন। নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো, গ্রাম ঘেরাও করে নিরীহ মানুষ হত্যা—এসব ঘটনা সীমাহীন নৃশংসতার উদাহরণ।” তারা আন্তর্জাতিক সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ভারতে শরণার্থী পরিস্থিতি ও শিক্ষার উদ্যোগ
কলকাতায় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক কামারুজ্জামান আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানান, শরণার্থী শিবিরে ১,৫০০ শিক্ষকের মাধ্যমে স্কুল কার্যক্রম চালানোর একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে। এর লক্ষ্য ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের শিক্ষা দেওয়া।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ অভিযান
২৭ মে দিনব্যাপী বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ চালান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা নদী: মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ ও ট্রাক ধ্বংস করেন এবং ৯ জন সেনাকে হত্যা করেন।
সাতক্ষীরার ভেড়ামারা বাঁধ: সারাদিনব্যাপী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়।
কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরী: তুমুল সংঘর্ষে ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
কুমিল্লার রাজাপুর: মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন।
পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের পদক্ষেপ
২৭ মে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন ৫১ নম্বর সামরিক বিধি জারি করে। এই বিধির আওতায় আপত্তিকর বইপত্র, পোস্টার, ও লিফলেট সামরিক দফতরে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদেশ অমান্যকারীদের ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক চাপ
ভারত সরকার পূর্ববাংলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্সসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে। পিটিআই সূত্রে জানা যায়, কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে ভারত কিছুটা সফল হলেও যুক্তরাজ্য নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখে।
২৭ মে ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনের মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে রাজনৈতিক বিবৃতি, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়।
মন্তব্য করুন