ঢাকা বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
বাজেট ২০২৫-২৬

বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণের বোঝা আরো বাড়বে

প্রিয়ভূমি ডেস্ক
০৩ জুন ২০২৫, ০৪:৫৭ পিএম
০৩ জুন ২০২৫, ০৭:২৪ পিএম
বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণের বোঝা আরো বাড়বে

ঋণ করে ঋণ শোধ করার যে নীতি বিগত সরকারের মেয়াদে গড়ে উঠেছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটেও তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ মুহূর্তে সরকারের ঘাড়ে চাপা ঋণের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের মধ্যেই সে বোঝা বেড়ে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে বলে প্রাক্কলন করেছে সরকার। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এ ঋণ আরো বেড়ে ২৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকায় ঠেকতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির এ চিত্র তুলে ধরা হয়।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত দেড় দশকের শাসনামলে ঘোষিত বাজেট ছিল অনেকটাই ঋণনির্ভর। প্রতি বছরই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়ানো হয়েছে বাজেটের আকার। তবে আয়ের উৎস সম্প্রসারণ করে নয়, বরং ঋণনির্ভর ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমেই এর আকার বড় করা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতেও ঋণনির্ভরতা কাটানোর দৃশ্যমান কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি।

সংসদ না থাকায় বেলা ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মাধ্যমে বাজেট বক্তব্য দেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত এ বাজেটের শিরোনাম দেয়া হয় বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়। পরে রাতেই রাষ্ট্রপতির সচিব ড. হাফিজ আহমেদ স্বাক্ষরিত অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। জারি করা অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সরকারের আর্থিক প্রস্তাবগুলো কার্যকর করা এবং এ-সংক্রান্ত উদ্দেশ্যগুলো পূরণের জন্য কিছু আইন সংশোধন সমীচীন ও প্রয়োজন। বর্তমানে সংসদ না থাকায় সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি এ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করেছেন। তবে প্রস্তাবিত বাজেটের বিষয়ে অংশীজনসহ সবার মতামতের ভিত্তিতে কোনো ধরনের সংশোধনের প্রয়োজন হলে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে অধ্যাদেশ সংশোধনের ভিত্তিতে আবার জারি করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যে অবশ্য দেশের অর্থনীতির বেহাল দশার চিত্রই ফুটে ওঠে। তিনি বলেছেন, ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

বাজেট বক্তৃতার সূচনায় অর্থ উপদেষ্টা যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, সেটির ধারাবাহিকতা বাকি অংশে ফুটে ওঠেনি। বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার যে প্রত্যয়ের কথা তিনি বলেছেন, সেটি বাস্তবায়নের রূপরেখাও বাজেটে দেখা যায়নি। বরং বিগত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসন কাঠামোর আদলে এবারের বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা হয়েছে। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এমন সময়ে বাজেট ঘোষণা করলেন যখন দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট চলছে। স্থবিরতা চলছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিতেও। কভিড-সৃষ্ট দুর্যোগে পর্যুদস্ত ২০১৯-২০ অর্থবছর বাদ দিলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২৫ বছরের মধ্যেই সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে মাত্র ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এর প্রধান কারণ কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের প্রবৃদ্ধি সামান্য বাড়লেও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। দেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের বৃহৎ অংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। অথচ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবৃদ্ধির খরা চলছে। টানা তিন অর্থবছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সর্বশেষ মে মাসেও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি দেখানো হয়েছে। ১৯৮৬ সালের পর দেশে কখনই টানা তিন বছর মূল্যস্ফীতি এতটা বেশি দেখা যায়নি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে মানুষ। এতে শ্লথ হয়েছে দেশজ সঞ্চয়ও। ব্যাংক খাতে চলতি বছরের মার্চে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির তুলনায় টানা ৩৯ মাস ধরে কম মজুরি বৃদ্ধির হার। এতে মানুষের প্রকৃত আয়ও কমে গেছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ায় বাড়ছে দরিদ্রের সংখ্যাও। আবার নাজুক ও বিশৃঙ্খল ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হারও ঠেকছে প্রায় ৩০ শতাংশে।

আর্থিক এ বেহাল পরিস্থিতির মধ্যেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। এটি চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম হলেও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। ঘোষিত আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের বেশি থাকা মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।

দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার এখন ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের প্রধান এ খাতে প্রাণসঞ্চারের কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না দিয়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। যদিও সংস্থাটির সংস্কার ইস্যুতে সরকারের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন রাজস্ব কর্মকর্তারা। আবার এনবিআর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ পালিয়ে যাওয়া অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর দেয়া বাজেটের মতোই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে তারল্য সংকটে থাকা দেশের ব্যাংক খাত থেকে। ব্যাংক-বহির্ভূত বিভিন্ন খাত থেকে নেয়া হবে আরো ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণ। বাকি ৯৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশী উৎস থেকে নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা যদিও বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ ছিল একটি বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট ঘোষণার। পুরনো ছক ও রীতি ঝেড়ে ফেলে বাস্তবতার পথে হাঁটার। কিন্তু ড. সালেহউদ্দিন সে পথে না হেঁটে রাজনৈতিক সরকারের ছকেই গতানুগতিক বাজেট ঘোষণা করেছেন। ফলে অতীতের মতো আগামী অর্থবছরের বাজেটও অবাস্তবায়িতই থেকে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কঠোর সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। বাজেটে সংস্কারের সেসব কার্যক্রম সামনে আনা উচিত ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুযোগ ছিল সংস্কারের মাধ্যমে কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব প্রশমিত করার। কিন্তু এবারের বাজেটেও আমরা এ ধরনের কোনো মৌলিক বা কৌশলগত সংস্কার দেখছি না, যেগুলো সাধারণ সময়ে করাটা কঠিন।

এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, সরকার যদি প্রস্তাবিত বাজেটে এসব সংস্কার শুরু করত তাহলে পরবর্তী সময়ে এগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা সহজ হতো। সেই সঙ্গে বৈষম্যহীন ও টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা যেত। আমার কাছে মনে হয়েছে এ বিষয়গুলো বাজেটে কিছুটা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এটি রাজনৈতিক সরকারের ঘোষণা করা গতানুগতিক বাজেটেরই প্রতিচ্ছবি।

অর্থ উপদেষ্টা যদিও তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, গত দেড় দশকে দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। তাই দেশকে পুনরায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এরই মধ্যে সব কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশনগুলোর দেয়া প্রস্তাবের আলোকে সরকার কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো তুলে ধরেন তিনি।

ঘোষিত বাজেটে ৯৭টি পণ্যের আমদানি শুল্ক বা কাস্টমস ডিউটি (সিডি) প্রত্যাহার, ৬০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস ও ৬৬টি পণ্যের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। এর বাইরে পরিশোধিত চিনির নির্ধারিত শুল্ক কমানো হয়েছে। ১৪টি পণ্যের নির্ধারিত শুল্ক পরিবর্তন করে হারভিত্তিক করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক বা এসডি আরোপ, হ্রাস ও বৃদ্ধি করা হয়েছে ১১০টি পণ্যের। আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটমুক্ত ১৬টি পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ১০টি পণ্যের আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও একটি পণ্যে আরোপ করা হয়েছে আগাম কর (এটি)। পেট্রোলিয়াম পণ্যে কাস্টমস ডিউটি বা আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। নিত্যপণ্যের আমদানি পর্যায়ে উৎসে করও ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়াবে বলে মনে করেন ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, পদ্ধতিগত সীমাদ্ধতার কারণে সরকারের রাজস্ব আয় কম। কিন্তু এটা যে বাড়বে, সে রকম কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। করজাল বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ আমরা এ বাজেটে দেখছি না। বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানো, ব্যবসাবান্ধব হওয়া এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও এসব লক্ষ্য অর্জিত হবে না।

আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী আরো বলেন, উৎপাদন খাতের বড় শিল্পের কাঁচামালের ভ্যাট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমাবে আমি ঠিক জানি না। সবকিছু আইএমএফের ফরমুলা অনুযায়ী করা হয়েছে। আইএমএফের ফরমুলা ধরলে তো ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতির মুখে পড়বে। এমনিতেই খরচ অনেক বেশি, জ্বালানির খরচ বেশি, ব্যাংক ঋণের সুদ অনেক বেশি, জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এতসব সংকেটর মধ্যেও যেসব ইন্ডাস্ট্রি মোটামুটি প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে সেখানেও শুল্ক ও কর বাড়ানো হয়েছে। টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত তুলার ওপর ২ শতাংশ এআইটি দিয়েছে। এমনিতেই কটনের দাম বেশি, এর সঙ্গে আরো ২ শতাংশ যোগ করলে তো স্পিনিং মিলগুলো আর টিকবে না।

শেখ হাসিনার গড়ে তোলা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় অপ্রয়োজনীয় অনেক মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। ঋণনির্ভর সেসব মেগা প্রকল্প উন্নয়নের কথা বলে নেয়া হলেও এক্ষেত্রে লুটপাটই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বলে অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা শ্বেতপত্রে তুলে ধরা হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ কমিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেটে এডিপি বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দও ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে পরিচালন ও নন-এডিপি খাতে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৫ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে ৫ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

দেড় দশক ধরে আকার বাড়িয়ে বাজেট ঘোষণা করা হলেও কোনো অর্থবছরেই বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগের ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ছিল ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, বছর শেষে এর ১৪-১৫ শতাংশ অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। পরে এ অবাস্তবায়িত বাজেটের অংশ আরো বড় হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করায় সরকারের ঋণের বোঝা কেবলই স্ফীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণ স্থিতি ছিল অন্তত ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন সরকারের ঋণ স্থিতি মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ছিল। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৬ লাখ ৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৬ শতাংশ। সরকারের নেয়া এ ঋণের সুদ পরিশোধেই চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৯৬ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, যা সরকারের মোট পরিচালন ব্যয়ের ৩০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে ৮১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ হয়েছে দেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের বিপরীতে। বাকি ১৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সুদ বিদেশী ঋণের জন্য পরিশোধ করতে হয়েছে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, সেখানেও ব্যয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত ধরা হয়েছে সুদ পরিশোধ। আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের বিপরীতে ১ লাখ কোটি এবং বিদেশী ঋণের জন্য ২২ হাজার কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করা হবে বলে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও বিদ্যমান বাস্তবতা বলছে, বছর শেষে এ সুদ ব্যয় আরো অনেক বেশি হবে। কারণ এ মুহূর্তে স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহারই ১২ শতাংশে উঠে গিয়েছে।

ঋণনির্ভর না হয়ে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় ব্যাংকগুলো হয়তো এ ঋণ সরকারকে জোগান দিতে পারবে। কারণ এ মুহূর্তে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা নেই। কিন্তু আগামীতে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে বেসরকারি খাতে অবশ্যই ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হবে। সরকারকে তার চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দেয়া হলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না, এটিই বাস্তবতা।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার এখন ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করছে। এটি আর কতদিন টেনে নেয়া যাবে। নিজেদের আয় বাড়াতে না পারলে সরকার ঋণচক্র থেকে বের হতে পারবে না। এরই মধ্যে ট্রেজারি বিলের সুদহার ১২ শতাংশে উঠে গেছে। আগামীতে এ সুদহার আরো বাড়তে পারে। তখন সরকারের সুদ খাতে ব্যয়ের চাপও বাড়বে।

যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্য ব্যাংক খাতকে হৃৎপিণ্ড মনে করা হয়। পুঁজিবাজার প্রাণবন্ত না হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ব্যাংক খাতের গুরুত্ব ও দায়িত্ব আরো বেশি। কিন্তু গত দেড় দশকে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাত এখন বিপর্যস্ত। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। মূলধন ঘাটতির কারণে ১৮টি তালিকাভুক্ত ব্যাংক লভ্যাংশও ঘোষণা করতে পারেনি। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তব্যে ব্যাংক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গও টেনেছেন। তিনি বলেছেন, বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট, দেউলিয়াত্ব বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি এমন সব ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেছে। সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ব্যাংক খাত সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তি তৈরি করতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের ব্যাপক গুণগত পর্যালোচনা করা, নীতি ও প্রবিধানের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ এবং ব্যাংক ব্যবস্থায় সুশাসন বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানো। এছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চুরি বা পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।

ড. সালেহউদ্দিন তার বাজেট বক্তব্যের উপসংহার টেনে বলেছেন, প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে আপাতত অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে আমরা অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছি। এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সর্বস্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আলোকবর্তিকা।

প্রথম প্রকাশ: বণিক বার্তা

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২২ জুলাই ১৯৭১: টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ

ভাড়ায় চাপাতি ও মোটরসাইকেল: রাজধানীর অপরাধ জগতের ভয়াবহ নতুন রূপ

রাজনীতির উনমানুষরাই প্রলাপ ডাকে বেশি

২১ জুলাই ১৯৭১: ঠাকুরগাঁওয়ে গেরিলা অভিযান মুক্তিযোদ্ধাদের

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল দাসত্ব: মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন

২০ জুলাই ১৯৭১: বিলমাড়িয়া হাটে গণহত্যা পাকিস্তানি সেনাদের

কোপার্নিকাস: আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

১৯ জুলাই ১৯৭১: ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর তিন দুঃসাহসিক অভিযান ও অন্যান্য ঘটনা

১০

বিভেদ-বিতর্ক রেখেও ঐক্য গড়া যায়

১১

১৮ জুলাই ১৯৭১: ভারতীয় সেনাপ্রধান হঠাৎ কলকাতায়

১২

১৭ জুলাই ১৯৭১: দেশজুড়ে মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান

১৩

১৬ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

১৪

জয় বাংলার উচ্ছ্বাস খুঁজি

১৫

১৫ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক ঘটনাবহুল দিন

১৬

নতুন আতঙ্ক জিকা ভাইরাস : করণীয় কী?

১৭

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ভূতের আক্রমণ

১৮

মিথ্যা তথ্যের জালে নতুন প্রজন্ম!

১৯

জানুয়ারি থেকে জুন, প্রতিদিন ১১ খুন

২০