যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনকারী দেশ। প্রায় ৮০টি দেশে ৭৫০টিরও বেশি মার্কিন ঘাঁটি ছড়িয়ে আছে, যা বিশ্বব্যাপী তাদের আধিপত্য ও হস্তক্ষেপের সাক্ষ্য দেয়। এই ঘাঁটিগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে স্থাপন করা হলেও বাস্তবে তা স্থানীয় জনগণের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাতিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া থেকে আফ্রিকা—প্রতিটি অঞ্চলেই মার্কিন সামরিক উপস্থিতি রক্তপাত, যুদ্ধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত।
মার্কিন সামরিক ঘাঁটির বিস্তার: একটি আন্তর্জাতিক আতঙ্ক
১. মধ্যপ্রাচ্য: যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে লক্ষ প্রাণ
ইরাক: ২০০৩ সালের আগ্রাসনের পর থেকে ১০ লক্ষেরও বেশি ইরাকি নিহত (ব্রাউন ইউনিভার্সিটির 'কস্টস অফ ওয়ার' প্রজেক্ট)। বাগদাদ, মসুল ও ফাল্লুজায় মার্কিন বাহিনীর হামলায় হাজারো শিশু-নারী মারা যায়।
সিরিয়া: আল-তানফ ও রমাদান শহরে মার্কিন ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও এখানে বিমান হামলায় ৩,০০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায় (সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস)।
ইয়েমেন: সৌদি আরবের সঙ্গে যৌথ হামলায় মার্কিন সমর্থনে ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে, যার বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক (ইউএন রিপোর্ট)।
২. এশিয়া-প্যাসিফিক: “শান্তিরক্ষা” নামে আধিপত্য বিস্তার
জাপান: ওকিনাওয়ায় মার্কিন ঘাঁটির বিরুদ্ধে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ করছে। এখানে মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়া: ১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে এখনও ২৮,৫০০ মার্কিন সৈন্য মোতায়েন আছে। স্থানীয়দের ওপর সহিংসতা ও দুর্ঘটনার ঘটনা নিয়মিত।
ফিলিপাইন: সাবিক বেসে মার্কিন উপস্থিতি স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করেছে। মোরো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মার্কিন সমর্থিত অপারেশনে ১ লক্ষাধিক মানুষ নিহত।
৩. ইউরোপ: ন্যাটোর নামে যুদ্ধের প্রস্তুতি
জার্মানি: রামস্টাইন এয়ার বেস থেকে ড্রোন হামলা চালানো হয়, যা ইরাক-আফগানিস্তানে বেসামরিক হতাহতের জন্য দায়ী।
ইতালি: সিসিলির সিগোনেলায় মার্কিন ঘাঁটি থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানো হয়।
৪. আফ্রিকা: “সন্ত্রাসবিরোধী” নামে নতুন উপনিবেশ
নাইজার: ২০১৭ সালে মার্কিন সেনাদের হামলায় নাইজেরিয়ান সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকরা নিহত হয়।
সোমালিয়া: ড্রোন হামলায় ৫০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে (আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল)।
৫. লাতিন আমেরিকা: অভ্যুত্থান ও হত্যার কেন্দ্র
কিউবা: গুয়ান্তানামো বে কারাগারে অমানবিক নির্যাতন ও গুমের অভিযোগ রয়েছে।
হন্ডুরাস: মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানের পর থেকে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের হত্যা বেড়েছে।
মার্কিন সামরিক অপারেশনে নিহতের ভয়াবহ পরিসংখ্যান
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণা অনুযায়ী, শুধু ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ৯ লক্ষ ৩৭ হাজারেরও বেশি মানুষ মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে ৩ লক্ষ ৮৭ হাজার বেসামরিক নাগরিক। এছাড়া--
আফগানিস্তান: ২ লক্ষ ৪৩ হাজার মৃত্যু (৪৩ হাজার বেসামরিক)।
ইয়েমেন: ৩ লক্ষ+ মৃত্যু, যার বেশিরভাগই দুর্ভিক্ষ ও হামলার শিকার।
সোমালিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া: মিলিয়ে আরও ২ লক্ষাধিক মৃত্যু।
বিশ্বজুড়ে মার্কিন সামরিকতন্ত্রের রক্তাক্ত ইতিহাস
“গণতন্ত্র রক্ষা” বা “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ”-এর নামে যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বে যেভাবে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর অধ্যায়গুলোর একটি। প্রতিটি ঘাঁটির পেছনে লুকিয়ে আছে স্থানীয় জনগণের রক্তঝরা আর্তনাদ। বিশ্ববাসীর উচিত এই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
তথ্যসূত্র
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির "কস্টস অফ ওয়ার" প্রজেক্ট
আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস
ইউএন রিপোর্টস অন ইয়েমেন ও ইরাক
মন্তব্য করুন