ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

শাওন মাহমুদ
প্রকাশ : ১২ মে ২০২৫, ০৪:২৫ পিএম
তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

প্রজন্ম একাত্তর, শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তানদের সংগঠন। প্রথম পোস্টার ছাপার সময় থেকে এক স্লোগানেই বিশ্বাস করে আসে এই সংগঠন—‘তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, ধারা নির্বিশেষে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ভাষা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যতার জন্য এক গণযুদ্ধ ছিল। সেই সময় শিল্পী, লেখক, ডাক্তার, সাংবাদিকের মতো বুদ্ধিজীবীদের সাথে সাধারণ মানুষের একাত্মতা এক বিশাল শক্তিশালী বলয় সৃষ্টি করেছিল। সেই বলয়ের শক্তিশালী ধাক্কায় মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছিল।

ত্রিশ লাখ শহীদের জীবন, তিন লাখ বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম, সাড়ে সাত কোটি জনগণের সমষ্টিগত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই ছোট্ট দেশটা আমাদের হয়েছিল।

গত পঞ্চাশ বছরে এই দেশে নিজস্ব ধারার রাজনৈতিক মতবাদের জায়গায় স্খলন এবং রাজনৈতিক পর্যায়ে উগ্র মৌলবাদের সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ চেতনাকে ঠেলে এক অচেনা দেশে পরিণত করেছে। আমাদের শ্রেষ্ঠ বীরেরা অর্থাৎ জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা এক যুদ্ধ জয়কেই শেষ অর্জন হিসেবে ধরে নিয়েছিল।

যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করা হয়েছিল তা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাদের কাছে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তারা দেশের হাল ধরেননি, আগামী প্রজন্মে চেতনা জাগ্রত করার বোধ তৈরি করেননি, মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের কথা লিখে যাননি, সঠিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেননি, শহীদ পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় অনুদান দেওয়ার জন্য মাঠে নামেননি, চেতনা জাগ্রত করার দাবি আদায় করেননি। যাদের হাত ধরে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্ম তারা একেক সরকারের সময় একেক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নিজেদের আখের গোছানো ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।

বছরের পর বছর গেলেও মুক্তিযুদ্ধ বা তার উদ্দেশ্য নিয়ে কঠিন পদক্ষেপ আর নেওয়া হয়নি। গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধারা নির্যাতিত হয়েছেন, শহীদ পরিবার সম্পত্তি হারা হয়েছেন। তাছাড়া সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ, আদিবাসীদের বাস্তুহারা, মন্দির, গির্জা ধ্বংস করাসহ তাদের ঘরছাড়া করার মতো নির্মম অঘটন ঘটেই যাচ্ছে।

উৎসব ভিত্তিক পার্বণগুলো এখন উগ্র মৌলবাদের দখলে। তারা এখন পূজামণ্ডপে আক্রমণ করে, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালায়, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং ব্যবসাপাতি ধ্বংস করার উদ্দামতায় উন্মাদ হয়ে ওঠে।

এদিকে এখনকার বুদ্ধিজীবীরা সরকারি দল ভিত্তিক বুদ্ধি চর্চা করে থাকেন। তাদের জোরালো কণ্ঠে দাবি আদায় বা প্রতিবাদ করার শব্দ শুনতে পায় না কেউ। রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর ন্যায্যতা আদায়ের দাবি শব্দহীন তাই।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা এখন আর তরুণ নেই, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড এখন ঝাপসা দেখায়। এদিকে শহীদ পরিবারগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে শক্তি হারিয়েছে।

শহীদ সন্তানদের একদমই একপাশে তুলে রাখা। তাদের হাতে সময়মতো আগামীর মশাল কেউ তুলে দেয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্তে ধারণ করা শহীদ সন্তানদের কথা কারো তেমন মনে নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমন্বয় করার মতো জোটবদ্ধ হওয়ার মতো আর কেউ বাকি নেই।

আমি বিশ্বাস করি আজ পর্যন্ত দেশবিরোধী সকল অপকর্মগুলো আমাদের নিষ্প্রভ পদচারণা থেকে আসা। আমাদের ভুলগুলো আমরা কখনো শোধরানোর চেষ্টা করিনি, আলোচনা করিনি। শুধুমাত্র নিজে ভালো থেকে, নিজ অবস্থান ঊর্ধ্বে রাখার অবিরাম চেষ্টায় চাপা দেওয়া হয়েছে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সফলতাগুলো।

সেই স্লোগান, তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? বাংলাদেশের যা যা বলার কথা ছিল তার থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে দেশ।

শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার এবং বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, এখন আর অর্থবহ অধ্যায় সৃষ্টি করে না। অসাম্প্রদায়িকতার পথ তাই মুখ থুবড়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। আগুনে পুড়তে থাকে সংখ্যালঘুর বসতবাড়ি, মূর্তির ভাঙা হাত মাটিতে লুটায়, কন্যারা ধর্ষিত হয় উগ্র শকুনের হাতে। না, তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে না তো বাংলাদেশ।

প্রথম প্রকাশ : ঢাকা পোস্ট

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০