ঢাকা রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

শাওন মাহমুদ
প্রকাশ : ১২ মে ২০২৫, ০৪:২৫ পিএম
তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

প্রজন্ম একাত্তর, শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তানদের সংগঠন। প্রথম পোস্টার ছাপার সময় থেকে এক স্লোগানেই বিশ্বাস করে আসে এই সংগঠন—‘তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, ধারা নির্বিশেষে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ভাষা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যতার জন্য এক গণযুদ্ধ ছিল। সেই সময় শিল্পী, লেখক, ডাক্তার, সাংবাদিকের মতো বুদ্ধিজীবীদের সাথে সাধারণ মানুষের একাত্মতা এক বিশাল শক্তিশালী বলয় সৃষ্টি করেছিল। সেই বলয়ের শক্তিশালী ধাক্কায় মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছিল।

ত্রিশ লাখ শহীদের জীবন, তিন লাখ বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম, সাড়ে সাত কোটি জনগণের সমষ্টিগত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই ছোট্ট দেশটা আমাদের হয়েছিল।

গত পঞ্চাশ বছরে এই দেশে নিজস্ব ধারার রাজনৈতিক মতবাদের জায়গায় স্খলন এবং রাজনৈতিক পর্যায়ে উগ্র মৌলবাদের সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ চেতনাকে ঠেলে এক অচেনা দেশে পরিণত করেছে। আমাদের শ্রেষ্ঠ বীরেরা অর্থাৎ জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা এক যুদ্ধ জয়কেই শেষ অর্জন হিসেবে ধরে নিয়েছিল।

যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করা হয়েছিল তা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাদের কাছে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তারা দেশের হাল ধরেননি, আগামী প্রজন্মে চেতনা জাগ্রত করার বোধ তৈরি করেননি, মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের কথা লিখে যাননি, সঠিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেননি, শহীদ পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় অনুদান দেওয়ার জন্য মাঠে নামেননি, চেতনা জাগ্রত করার দাবি আদায় করেননি। যাদের হাত ধরে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্ম তারা একেক সরকারের সময় একেক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নিজেদের আখের গোছানো ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।

বছরের পর বছর গেলেও মুক্তিযুদ্ধ বা তার উদ্দেশ্য নিয়ে কঠিন পদক্ষেপ আর নেওয়া হয়নি। গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধারা নির্যাতিত হয়েছেন, শহীদ পরিবার সম্পত্তি হারা হয়েছেন। তাছাড়া সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ, আদিবাসীদের বাস্তুহারা, মন্দির, গির্জা ধ্বংস করাসহ তাদের ঘরছাড়া করার মতো নির্মম অঘটন ঘটেই যাচ্ছে।

উৎসব ভিত্তিক পার্বণগুলো এখন উগ্র মৌলবাদের দখলে। তারা এখন পূজামণ্ডপে আক্রমণ করে, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালায়, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং ব্যবসাপাতি ধ্বংস করার উদ্দামতায় উন্মাদ হয়ে ওঠে।

এদিকে এখনকার বুদ্ধিজীবীরা সরকারি দল ভিত্তিক বুদ্ধি চর্চা করে থাকেন। তাদের জোরালো কণ্ঠে দাবি আদায় বা প্রতিবাদ করার শব্দ শুনতে পায় না কেউ। রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর ন্যায্যতা আদায়ের দাবি শব্দহীন তাই।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা এখন আর তরুণ নেই, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড এখন ঝাপসা দেখায়। এদিকে শহীদ পরিবারগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে শক্তি হারিয়েছে।

শহীদ সন্তানদের একদমই একপাশে তুলে রাখা। তাদের হাতে সময়মতো আগামীর মশাল কেউ তুলে দেয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্তে ধারণ করা শহীদ সন্তানদের কথা কারো তেমন মনে নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমন্বয় করার মতো জোটবদ্ধ হওয়ার মতো আর কেউ বাকি নেই।

আমি বিশ্বাস করি আজ পর্যন্ত দেশবিরোধী সকল অপকর্মগুলো আমাদের নিষ্প্রভ পদচারণা থেকে আসা। আমাদের ভুলগুলো আমরা কখনো শোধরানোর চেষ্টা করিনি, আলোচনা করিনি। শুধুমাত্র নিজে ভালো থেকে, নিজ অবস্থান ঊর্ধ্বে রাখার অবিরাম চেষ্টায় চাপা দেওয়া হয়েছে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সফলতাগুলো।

সেই স্লোগান, তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? বাংলাদেশের যা যা বলার কথা ছিল তার থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে দেশ।

শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার এবং বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, এখন আর অর্থবহ অধ্যায় সৃষ্টি করে না। অসাম্প্রদায়িকতার পথ তাই মুখ থুবড়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। আগুনে পুড়তে থাকে সংখ্যালঘুর বসতবাড়ি, মূর্তির ভাঙা হাত মাটিতে লুটায়, কন্যারা ধর্ষিত হয় উগ্র শকুনের হাতে। না, তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে না তো বাংলাদেশ।

প্রথম প্রকাশ : ঢাকা পোস্ট

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ধর্মান্ধতার শিকার প্রান্তিক নারীজীবনের কথাশিল্পী বানু মুশতাক

আইএমএফের পরামর্শ / ডলারের দাম বাজারীকরণের বিপদ

সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা

ভ্রমণপ্রেমী গভর্নরের নয় মাসে ৬৫ দিন বিদেশ সফর

বাজেটে স্বস্তি নেই মধ্যবিত্তের

কোদালিয়া গণহত্যা / নগরকান্দার রক্তঝরা ইতিহাস

১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

১০

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

১১

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

১২

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

১৩

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

১৪

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

১৫

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

১৬

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১৭

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১৮

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

১৯

জনগণ আসলে কী চায়

২০