ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার পদ্মানদীর মাঝি

ড. মো. সাইফুজ্ জামান
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫, ০৪:৩১ পিএম
পদ্মানদীর মাঝি

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬), লেখক নাম এটি। তার প্রকৃত নাম প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত একান্নবর্তী বৃহৎ পরিবারের সন্তান। তারা ছিলেন আট ভাই ছয় বোন। ভাইদের মধ্যে মানিকের অবস্থান ছিল চতুর্থ। বাবার বদলির চাকরি সূত্রে মানিকের বাল্য ও কৈশোর এবং স্কুলজীবন কেটেছে বিভিন্ন জায়গায়। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন খুব দুরন্ত অথচ সহিষ্ণু। দুরন্তপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তীব্র অনুসন্ধিৎসা। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রবেশিকা ও আইএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে। প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে বিএসসি পড়তে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯২৮ সালে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রথম গল্প ছাপা হওয়ায় তার জীবনধারা বদলে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে গল্প লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন তিনি। অতসী মামী, ১৯২৮ সাল, মানিকের বয়স তখন কুড়ি বছর, মৃত্যুকালে আটচল্লিশ। দিবারাত্রির কাব্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম লেখা উপন্যাস। লেখালেখিসহ পত্রপত্রিকায় চাকরি করেন কিছুদিন। সাম্প্রদায়িকতা ও দাঙ্গাবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং পার্টি ফান্ডে পৈতৃক বাড়ি বিক্রির অংশীদার হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ দান করেন। কিন্তু কখনো ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেননি। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন বটে, মনেপ্রাণে তা-ই ছিলেন, জীবনধারায় ও সাহিত্যচেতনায়, কারও তোয়াক্কা করেননি। দায়িত্বশীল মানিক তার আরও বড়-ছোট ভাই থাকা সত্ত্বেও, নিজের বিপুল দারিদ্র্য সত্ত্বেও বৃদ্ধ পিতার ভার গ্রহণ করেন- যে পিতা ছেলের মৃত্যুর পরও জীবিত থাকেন অনেক দিন। মানিকের সাহিত্যের মধ্যে ফ্রয়েডের তত্ত্বের প্রয়োগ করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে মহত্তম ব্যক্তিত্ব। মনের গভীরে অশান্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে অবস্থান ও কর্মপ্রযত্ন নির্বাচন করেছিলেন। মানিক সাহিত্যে অবতীর্ণ হন ১৯২৮ সালে। গ্রন্থকার রূপে প্রথম প্রকাশিত হন ১৯৩৫ সালে।

মানিকের দুটি উপন্যাস- পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা ১৯৩৬ সালে একই বছরে প্রকাশিত। পদ্মানদীর মাঝিতে ইউটোপিয়া বা স্বপ্নরাজ্য কল্পনা করেছেন। পদ্মা নদীকে অবলম্বন করে একটি উপন্যাস রচনা, উপন্যাসের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পদ্মার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে অন্বিষ্ট হয়েছে নদীতীরবর্তী ধীবর-পল্লির সামগ্রিক জীবনবৈশিষ্ট্য এবং সেই সঙ্গে কুবের চরিত্রের জীবনোদ্যমের উৎস ও পরিণতির নানাবিধ বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ ও স্বরূপ। তবে ব্যক্তি কিংবা সমাজজীবনে সর্বত্রই পদ্মার ভূমিকা অতিশয় প্রত্যক্ষ। একটি স্বতন্ত্র ও প্রধান চরিত্র হিসেবে পদ্মা এ উপন্যাসে সক্রিয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের শুরুই হয়েছে পদ্মার রূপ বর্ণনার মধ্যদিয়ে। বর্ষার মাঝামাঝি ইলিশ ধরার মৌসুমে রাত্রিকালীন পদ্মার রূপ চিত্রণে লেখক সংকেতময় উপমামণ্ডিত ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন। লেখকের দৃষ্টিতে, নদীর বুকে শত শত জেলেনৌকার আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরে বেড়ায়, নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে ওই আলোগুলো সঞ্চারিত হয় দুর্বোধ্য সংকেতের মতো। গভীর রাতে সারা পৃথিবী যখন নিদ্রামগ্ন তখনো আলোগুলো থাকে অনির্বাপিত। ওই আলোয় ইলিশের নিস্পলক চোখগুলোও হয়ে ওঠে স্বচ্ছ নীলাভ মণিসদৃশ।

পদ্মার এ ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য ও তারুণ্য এর তীরবর্তী জেলে-মাঝিদের কাছে আকর্ষণীয়। পদ্মা যেমন মৎস্যসম্পদের উৎস, তেমনি যোগাযোগেরও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, এ মৎস্য আহরণ ও ব্যবসাসূত্রেই দরিদ্র জেলে মাঝিরা শোষণের শিকার হয়। পদ্মায় ইলিশ শিকার সূত্রে শীতল ও ধনঞ্জয় কর্তৃক দরিদ্র কুবেরের শোষিত হওয়ার চিত্র প্রত্যক্ষ করি। কেবল নৌকা ও জালের মালিক হওয়ার কারণেই বিনাশ্রমে তারা আহরিত সম্পদের অর্ধেক মালিকানা ভোগ করেন। এ উপন্যাসের শোষণের সবচেয়ে বড় আয়োজন হোসেন মিয়ার। পদ্মার জলপথ ধরেই বৈধ-অবৈধ নানা ব্যবসায়িক কর্মোদ্যমে অতি দ্রুত স্ফীত পুঁজির অধিকারী হোসেন মিয়া অকূল সমুদ্র-মধ্যে একটি আস্ত দ্বীপের মালিক হয়ে ওঠেন। অতঃপর মনুষ্যবাসের অযোগ্য এ ময়নাদ্বীপকে বসতিপূর্ণ করার অভিপ্রায়ে তার শোষকচিত্ত হয়ে ওঠে কৌশলপরায়ণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সংযমী এবং লক্ষ্যাভমুখী। এ বসতি নির্মাণ পরিকল্পনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে হোসেন মিয়ার শোষণজাল মূলত কেতুপুরের ধীবর-পল্লিকে আশ্রয় করলেও পার্শ্ববর্তী বহু গ্রামে তা বিস্তৃত হয়। ময়নাদ্বীপকে জনবসতীতে পূর্ণ করার বাসনা কোনো মানবসেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণের স্বপ্ন নয়। এটি মাদক চোরাচালানির সাম্রাজ্য বা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা মাত্র।

মানুষের মনকে কি এ রকম কোনো জল-অচল-ভাগে বিভক্ত করা যায়? মানিকের জীবনের ও রচনার সন্ধান জীবনকে দেখার বিরতিহীন শ্রম। মানিক লিখেছেন- লিখতে আরম্ভ করার পর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গির আগেও ঘটেছে, মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয় হবার পর আরও ব্যাপক ও গভীরভাবে সে পরিবর্তন ঘটাবার প্রয়োজন অনুভব করি।

কমিউনিজম গ্রহণের আগে ও পরে মানিকের সাহিত্যের যে বিভাজন করা হয়ে থাকে তা সাধারণভাবে সত্য হলেও গভীর অর্থে সত্য নয়। পদ্মানদীর মাঝি এমন একটি উপন্যাস, যেখানে চিত্রিত হয়েছে নিম্নবিত্তের জীবন, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সংকীর্ণতাকেও আক্রমণ করা হয়েছে। তখনো মানিক মার্কসবাদের দীক্ষা নেননি। পদ্মানদীর মাঝি বহির্জীবনের গাথা, কিন্তু অন্তর্জীবনেরও। কমিউনিজম গ্রহণের অনেক আগে রচিত এ উপন্যাস প্রমাণ করে যে, মানিকের জীবন দ্বিধাবিভক্ত ছিল না; সাধারণ মানুষের প্রতি প্রথম থেকেই তার ছিল ঐকান্তিক ভালোবাসা, আগ্রহ ও সহানুভূতি। পদ্মানদী মাঝি উপন্যাসের মহৎ সাফল্য এখানে যে, ওই বহির্মুখ ও অন্তর্মুখ ধারার বিরাট বিস্তারিত সংমিশ্রণ এখানে ঘটেছে। ওই সংমিশ্রণ বিশেষভাবে লক্ষ করেছেন মানিক নিম্ন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে। ওই সংমিশ্রণের ফলেই পদ্মা নদীর তীরবর্তী মানুষ নেহাত আঞ্চলিক চরিত্র হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে ব্যক্তিত্বচিহ্নিত মানুষ। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ণ। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সঙ্কীর্ণতায়। আর দেশী মদে। তালের রস গাজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০