ঢাকা শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ৩১ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৫, ০২:২০ পিএম
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি শিশু তার পরিবারের সঙ্গে চলার পথে একটি পতাকা বহন করছে | ছবি: অমিয় চক্রবর্তী

১৯৭১ সালের ২ জুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অল ইন্ডিয়া রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যে কোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পাশাপাশি, বাংলাদেশ প্রতিবেশী ও অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী।

মাওলানা ভাসানীর দৃঢ় ঘোষণা

এদিনই পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের অসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবের জবাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্পষ্ট ভাষায় বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের একমাত্র লক্ষ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। তিনি যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, “হয় বিজয়, নয় মৃত্যু—এই আমাদের পথ।”

ভাসানী আরও জোর দেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সুসংগঠিত করতে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিভেদনীতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে জনগণকে আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থনও এই দিনে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভ্যাটিকান সিটির পোপ ষষ্ঠ পল বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশার প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামের সাথে একাত্মতা জানান।

জাতিসংঘের তরফে জানানো হয়, শরণার্থীদের সহায়তায় কানাডা ১.৫ কোটি ভারতীয় রুপির সমতুল্য খাদ্য ও ওষুধ পাঠাচ্ছে। এছাড়াও, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) অতিরিক্ত ২৫ লাখ ডলারের খাদ্য সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সিনেটে এক জোরালো বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংসতা ও শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “বিশ্ব সম্প্রদায় কতদিন নীরব থাকবে? একটি জাতির ধ্বংসের দৃশ্য আমরা আর কতকাল দেখব?”

ব্রিটেনে বাংলাদেশের পক্ষে সোচ্চার আওয়াজ

লন্ডনে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর উদ্যোগে এক সমাবেশে ভারতের বিশিষ্ট সমাজকর্মী জয়প্রকাশ নারায়ণ, বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিন সদস্য জন স্টোনহাউস, পিটার শোর ও মাইকেল বার্নস বক্তব্য রাখেন।

জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, যদিও তিনি একজন শান্তিবাদী, তবুও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরোধকে সমর্থন করেন। তিনি ভারত সরকারকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

মাইকেল বার্নস তার বক্তব্যে বলেন, “পূর্ব বাংলার ট্র্যাজেডি শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়—এটি একটি আন্তর্জাতিক মানবিক সংকট। বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।”

ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ইস্যু

ভারতের রাজ্যসভার সদস্য রাজনারায়ণ সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় প্রতিবাদে সভা বর্জন করেন। তিনি সংসদে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্বীকৃতির জন্য আবেদন করলেও ভারত সরকার তা উপেক্ষা করছে।

এদিকে, পাঞ্জাব সরকার বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহায়তায় ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করে।

শরণার্থী শিবিরে কলেরার প্রাদুর্ভাব

পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় শরণার্থী শিবিরগুলোর অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেয়। জেলা প্রশাসক জানান, মাত্র চার দিনে প্রায় ১,৫০০ শরণার্থী কলেরায় মারা গেছেন, আরও ২,০০০ আক্রান্ত। তিনি জেলাকে মহামারি-প্রবণ অঞ্চল ঘোষণা করে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা ও ওষুধ পাঠানোর আহ্বান জানান।

পাকিস্তানি শাসনের কঠোর নীতি

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ছুটিতে থাকা সরকারি কর্মচারীদের দ্রুত কাজে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়, অন্যথায় শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান শিক্ষকদের কাজে যোগদানের জন্য চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যোগ না দিলে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে এবং সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।

সূত্র

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য – আবদুল মতিন (সাহিত্য প্রকাশ)

পূর্বদেশ ও দৈনিক পাকিস্তান, ৩-৫ জুন ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর (ভারত), ৩-৪ জুন ১৯৭১

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০