ঢাকা সোমবার, ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৫, ১২:৩১ পিএম
ছবি: আনন্দবাজার
ছবি: আনন্দবাজার

মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ঘোষণা: সমঝোতার অবকাশ নেই

১৯৭১ সালের ৩১ মে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, “এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো সমঝোতা, আলোচনা বা রাজনৈতিক মীমাংসার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ।” তিনি পাকিস্তান সরকারের আন্তর্জাতিক মহলে দেওয়া প্রস্তাবগুলোকে “সময় নষ্টকারী” আখ্যা দিয়ে বলেন, “রাজনৈতিক সমঝোতার নামে পাকিস্তানের প্রহসন বন্ধ করতে হবে।”

মাওলানা ভাসানী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর নীরবতাকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম ও আলবেনিয়ার মতো দেশগুলো মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে কথা বলছে না। ভিয়েতনামের জন্য আমরা আন্দোলন করেছি, কিন্তু আজ তারাও নিশ্চুপ। আমাদের লড়াই শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম।”

ভারতের নীতিনির্ধারণী বৈঠক: বাংলাদেশ ইস্যুতে জোরালো ভূমিকা

৩১ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সভাপতিত্বে ভারতীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করে। বৈঠকে শরণার্থী সংকট, সীমান্তে উত্তেজনা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সতর্ক করে বলেন, “পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি হুমকির মুখে ফেলেছে।”

জাতিসংঘে জোরালো উদ্যোগ: নিরাপত্তা পরিষদে এই ইস্যু তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। (চীনকে ভারতের স্বীকৃতি না দেওয়ায় তাদের সঙ্গে আলোচনা বাদ পড়ে।)

ভুট্টোর বিবৃতি: “মুজিবের ভুল আমরা করব না”

পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে বিবৃতি দিয়ে বলেন, “পাকিস্তানের সংকট সমাধানে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় আসা প্রয়োজন। শেখ মুজিবুর রহমানের ভুল আমরা পুনরাবৃত্তি করব না।” তিনি ইঙ্গিত দেন যে, "জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই একমাত্র সমাধান।"

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো সমর্থন

কলেরা প্রতিরোধ: বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মধ্যে কলেরা ছড়িয়ে পড়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ কলেরা টিকা ও ৪০ লাখ খাবার স্যালাইন পাঠায়।

স্বীকৃতির দাবিতে মিছিল: কলকাতা পৌর কর্পোরেশনের মেয়র শ্যামসুন্দর গুপ্তের নেতৃত্বে কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের একটি মিছিল রাজ্যপালের বাসভবনে যায়। তারা বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি জমা দেয়।

প্রবাসী সরকারের বক্তব্য: দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র আমজাদুল হক বলেন, "পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর যুক্ত পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোনো সমাধান অসম্ভব। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।"

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

শ্রীলঙ্কার সংসদে প্রস্তাব: তামিল ফেডারেল পার্টির সদস্য ভি. ধর্মালিঙ্গন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে শ্রীলঙ্কার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

বিশ্বব্যাংকের মিশন: এম.এইচ. উইহেনের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের একটি দল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট মূল্যায়নের জন্য রওনা হয়।

পাকিস্তানি দলগুলোর অবস্থান

কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান এ.এস.এম. সোলায়মান সুইজারল্যান্ডে গিয়ে বলেন, “আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় কঠোর হব।”

জমিয়তুল ইসলামের মাওলানা হাজারভী ভারতের “প্রচারণা” মোকাবিলায় বিদেশে প্রতিনিধি পাঠানোর আহ্বান জানান।

কনভেনশন মুসলিম লীগের এ.এন.এম. ইউসুফ দাবি করেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এখন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড বুঝতে পেরেছে।”

মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অভিযান

কুমিল্লার জগমোহনপুর: লেফটেন্যান্ট মাহবুবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ১২ জন সেনা হত্যা করে।

সিঙ্গারবিলে অ্যাম্বুশ: মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর ১৩ জন নিহত হয়।

শালদা রেলস্টেশন: সুবেদার আবদুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ৬ মুক্তিযোদ্ধা হামলা চালিয়ে ২ পাকিস্তানি সেনা খতম করে।

৩১ মে ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন ছিল। মাওলানা ভাসানীর দৃঢ় ঘোষণা, ভারতের কূটনৈতিক উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অপারেশন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বেগবান করে। এই দিনটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ খণ্ড)

দৈনিক পাকিস্তান, ১ জুন ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১ জুন ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর (ভারত), ১ জুন ১৯৭১

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন

ধর্মান্ধতার শিকার প্রান্তিক নারীজীবনের কথাশিল্পী বানু মুশতাক

আইএমএফের পরামর্শ / ডলারের দাম বাজারীকরণের বিপদ

সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা

ভ্রমণপ্রেমী গভর্নরের নয় মাসে ৬৫ দিন বিদেশ সফর

বাজেটে স্বস্তি নেই মধ্যবিত্তের

কোদালিয়া গণহত্যা / নগরকান্দার রক্তঝরা ইতিহাস

১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

১০

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

১১

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

১২

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

১৩

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

১৪

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

১৫

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

১৬

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

১৭

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১৮

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১৯

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

২০