ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

কলসকাঠি গণহত্যা, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ
প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৫, ১২:১৯ পিএম
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ | ছবি: আনন্দবাজার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ | ছবি: আনন্দবাজার

১৯৭১ সালের ২৮ মে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যা চালানো হয় বরিশালের কলসকাঠিতে এবং মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও ভূরুঙ্গামারীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয়তা

বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৮ মে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, "পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার পর অখণ্ড পাকিস্তানের ভিত্তিতে আপস করা অসম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ছয় মাস বা তার বেশি সময় লাগতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশই বিজয়ী হবে।" তিনি জাতিসংঘকে পাকিস্তানকে সাহায্য না দেওয়ারও আহ্বান জানান।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লেখেন। তাতে তিনি দাবি করেন, "যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি করানোর চেষ্টা করছে।" তবে তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ইয়াহিয়া খানকে লেখা চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানের ইস্যুতে পাকিস্তানের নীতিকে সমর্থন জানান।

ব্রিটিশ এমপি মাইকেল বার্নসের সমর্থন

ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান মাইকেল বার্নস কলকাতার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে বলেন, "পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার না করলে বিশ্বকে তাদের সাহায্য বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের সংকট আন্তর্জাতিক ইস্যু, এবং ব্রিটেনের জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে।"

ভারতের অবদান ও স্থানীয় উদ্যোগ

কলকাতা পৌর করপোরেশন সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের নাম পরিবর্তন করে "বাংলাদেশ শহীদ সরণি" রাখে এবং শরণার্থীদের জন্য ১ লাখ টাকা অনুদান দেয়।

মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি সীমান্তে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের পরিচালিত ১২টি শিবিরে ২.৫ লাখ শরণার্থী আশ্রয় পেয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি

কলসকাঠি গণহত্যা (বরিশাল)

পাকিস্তানি সেনারা ক্যাপ্টেন হানিফের নেতৃত্বে কলসকাঠি গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ঘেরাও করে। ৮৭ জন পুরুষকে গ্রেপ্তার করে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় এবং লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। গ্রামটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান

কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অ্যামবুশ করে কয়েকজনকে হতাহত করে। জবাবে পাকিস্তানিরা মনোহরপুর ও মাগুরা গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে।

রাজারমার দীঘি (কুমিল্লা)-তে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা করে একটি বাংকার ধ্বংস করে অস্ত্র লুট করে।

ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) দখল করে পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে আসামের সোনাহাট ও কোচবিহারের সাহেবগঞ্জে আশ্রয় নেন।

ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র

বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি হেমডিক ফ্যানডং কুষ্টিয়া সফর শেষে লিখেন, "এখানকার ধ্বংসস্তূপ দেখলে মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত জার্মান শহরের কথা।"

পাকিস্তানের সমর্থকদের তৎপরতা

শর্ষিনার পীর মওলানা শাহ আবু জাফর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের "ধ্বংস" করার আহ্বান জানান।

ঢাকার কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির নেতা খাজা খয়রুদ্দিন বলেন, "মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় চরদের নির্মূলে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা আমাদের ফরজ দায়িত্ব।"

২৮ মে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো সমর্থন পায়, একইসাথে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা ও সমর্থকদের অপপ্রচারও অব্যাহত থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, গণহত্যার শিকার মানুষের বীরত্ব এবং বিশ্ব-এর সচেতনতা—সব মিলিয়ে এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

সূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (তৃতীয় ও ত্রয়োদশ খণ্ড)

দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ মে ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯-৩০ মে ১৯৭১

সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২, ৫, ৭)

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাথরাইল-নলশোদা গণহত্যা (দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল)

৩০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর সফল গেরিলা অভিযান

গঙ্গাচড়ার সহিংসতা / রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও সমাজের নীরবতা

২৯ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ কার্যক্রম তীব্রতর

সংবিধানের সঙ

২৭ জুলাই ১৯৭১: বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাহসী আক্রমণ

২৬ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

রাধুটিলা গণহত্যা (বিয়ানীবাজার, সিলেট)

২৪ জুলাই ১৯৭১: ভেনিজুয়েলা ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ

পাতারচর গণহত্যা (মুলাদী, বরিশাল)

১০

মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়

১১

২৩ জুলাই ১৯৭১: বিশ্ব শক্তি বাংলাদেশ সংকট নিয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত

১২

২২ জুলাই ১৯৭১: টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ

১৩

ভাড়ায় চাপাতি ও মোটরসাইকেল: রাজধানীর অপরাধ জগতের ভয়াবহ নতুন রূপ

১৪

রাজনীতির উনমানুষরাই প্রলাপ ডাকে বেশি

১৫

২১ জুলাই ১৯৭১: ঠাকুরগাঁওয়ে গেরিলা অভিযান মুক্তিযোদ্ধাদের

১৬

মবতন্ত্রের জয়

১৭

ডিজিটাল দাসত্ব: মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

১৮

২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন

১৯

২০ জুলাই ১৯৭১: বিলমাড়িয়া হাটে গণহত্যা পাকিস্তানি সেনাদের

২০