ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

কলসকাঠি গণহত্যা, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ
প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৫, ১২:১৯ পিএম
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ | ছবি: আনন্দবাজার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ | ছবি: আনন্দবাজার

১৯৭১ সালের ২৮ মে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যা চালানো হয় বরিশালের কলসকাঠিতে এবং মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও ভূরুঙ্গামারীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয়তা

বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৮ মে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, "পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার পর অখণ্ড পাকিস্তানের ভিত্তিতে আপস করা অসম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ছয় মাস বা তার বেশি সময় লাগতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশই বিজয়ী হবে।" তিনি জাতিসংঘকে পাকিস্তানকে সাহায্য না দেওয়ারও আহ্বান জানান।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লেখেন। তাতে তিনি দাবি করেন, "যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি করানোর চেষ্টা করছে।" তবে তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ইয়াহিয়া খানকে লেখা চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানের ইস্যুতে পাকিস্তানের নীতিকে সমর্থন জানান।

ব্রিটিশ এমপি মাইকেল বার্নসের সমর্থন

ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান মাইকেল বার্নস কলকাতার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে বলেন, "পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার না করলে বিশ্বকে তাদের সাহায্য বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের সংকট আন্তর্জাতিক ইস্যু, এবং ব্রিটেনের জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে।"

ভারতের অবদান ও স্থানীয় উদ্যোগ

কলকাতা পৌর করপোরেশন সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের নাম পরিবর্তন করে "বাংলাদেশ শহীদ সরণি" রাখে এবং শরণার্থীদের জন্য ১ লাখ টাকা অনুদান দেয়।

মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি সীমান্তে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের পরিচালিত ১২টি শিবিরে ২.৫ লাখ শরণার্থী আশ্রয় পেয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি

কলসকাঠি গণহত্যা (বরিশাল)

পাকিস্তানি সেনারা ক্যাপ্টেন হানিফের নেতৃত্বে কলসকাঠি গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ঘেরাও করে। ৮৭ জন পুরুষকে গ্রেপ্তার করে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় এবং লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। গ্রামটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান

কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অ্যামবুশ করে কয়েকজনকে হতাহত করে। জবাবে পাকিস্তানিরা মনোহরপুর ও মাগুরা গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে।

রাজারমার দীঘি (কুমিল্লা)-তে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা করে একটি বাংকার ধ্বংস করে অস্ত্র লুট করে।

ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) দখল করে পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে আসামের সোনাহাট ও কোচবিহারের সাহেবগঞ্জে আশ্রয় নেন।

ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র

বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি হেমডিক ফ্যানডং কুষ্টিয়া সফর শেষে লিখেন, "এখানকার ধ্বংসস্তূপ দেখলে মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত জার্মান শহরের কথা।"

পাকিস্তানের সমর্থকদের তৎপরতা

শর্ষিনার পীর মওলানা শাহ আবু জাফর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের "ধ্বংস" করার আহ্বান জানান।

ঢাকার কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির নেতা খাজা খয়রুদ্দিন বলেন, "মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় চরদের নির্মূলে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা আমাদের ফরজ দায়িত্ব।"

২৮ মে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো সমর্থন পায়, একইসাথে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা ও সমর্থকদের অপপ্রচারও অব্যাহত থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, গণহত্যার শিকার মানুষের বীরত্ব এবং বিশ্ব-এর সচেতনতা—সব মিলিয়ে এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

সূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (তৃতীয় ও ত্রয়োদশ খণ্ড)

দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ মে ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯-৩০ মে ১৯৭১

সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২, ৫, ৭)

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১০

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১১

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১২

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৩

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৪

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৫

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৬

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৭

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

১৮

৩০ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট

১৯

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা দেশ কখনোই সভ্য হতে পারে না

২০