১৯৭১ সালের ২৬ মে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন দেশ-বিদেশে নানাবিধ ঘটনা সংঘটিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করে। কলকাতায় কবি নজরুলের জন্মদিন উদযাপন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সংসদে বক্তব্য, আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতিক্রিয়া এবং দেশের ভেতরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যা ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ—এই দিনের ঘটনাপ্রবাহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
১. আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় প্রেক্ষাপট
১.১. ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভায় বক্তব্য: ২৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানি আগ্রাসন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তাঁর মূল বক্তব্যের বিশেষ অংশ--
গণহত্যার ভয়াবহতা: তিনি বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ভয়াবহ গণহত্যা চলছে, যা বিশ্ব সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করা উচিত। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কেউই রেহাই পাচ্ছে না।"
ভারতের অবস্থান: "ভারত শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে, কিন্তু এই সংকটের স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।"
স্বীকৃতির প্রশ্ন: তিনি ইঙ্গিত দেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি ভারত বিবেচনা করছে, তবে তা কৌশলগতভাবে হবে।
সতর্কবার্তা: তিনি সতর্ক করে বলেন, "পাকিস্তান যদি সংযত না হয়, তাহলে পরিণাম ভয়াবহ হবে।"
১.২. ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি
দিল্লিতে এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান ‘গত তিন দিন ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও হামলা চালাচ্ছে। পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পূর্ণ প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
১.৩. ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবেদন
ওয়ার অন ওয়ান্টের দুই প্রতিনিধি জন হরগান ও রেভারেন্ড ব্রুসকেন্ট সীমান্তের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে কলকাতায় বলেন- “পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি পাকিস্তান সরকার প্রত্যাখান করেছে।”
শরণার্থীরা পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বর্ণনা দিয়েছে। ভারতের মানবিক সহায়তার প্রশংসা করেন।
১.৪. জাতিসংঘ ও মার্কিন অবস্থান
জাতিসংঘের মুখপাত্র জানান, যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সহায়তায় রাজি আছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের চার্লস ডব্লিউ ব্রে বলেন, "এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, হস্তক্ষেপ করা যাবে না।"
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কিথ হলিয়ক সিঙ্গাপুরে বলেন, "গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।"
১.৫. ব্রিটেনে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
কেন্টের ক্রিকেট মাঠে পাকিস্তান বনাম কেন্টের ম্যাচে ৫০-৬০ জন বাঙালি প্ল্যাকার্ড নিয়ে নীরব প্রতিবাদ করে।
‘স্টপ জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগান দেওয়া হয়।
কিছু প্রতিবাদকারী মাঠে ঢুকে খেলা বাধাগ্রস্ত করে।
২. কবি নজরুলের জন্মদিন উদযাপন
২৬ মে ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭২তম জন্মদিন। কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিকদের উদ্যোগে নজরুলের জন্মদিন পালিত হয়:
বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী কবিভবনে গিয়ে নজরুলকে মাল্য পরান।
সঙ্গীতানুষ্ঠান
গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ গান পরিবেশন করে।
সন্জীদা খাতুন ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেন।
রণেশ দাশগুপ্তসহ বহু বুদ্ধিজীবী কবিকে শ্রদ্ধা জানান।
৩. বাংলাদেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি
৩.১. সিলেটের বুরুঙ্গা গণহত্যা (৯৪ জন নিহত) ঘটনাস্থল: বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয় মাঠ।
পাকিস্তানি কমান্ডার: ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন, স্থানীয় রাজাকার নেতা আব্দুল আহাদ চৌধুরী ও ড. আব্দুল খালেকের সহায়তায়।
ঘটনাক্রম
স্থানীয়দের শান্তি কমিটির মিথ্যা আশ্বাসে ডেকে এনে হিন্দুদের আলাদা করা হয়।
৯৪ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়।
লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়।
আহতদের সাক্ষ্য: শ্রীনিবাস চক্রবর্তী (জীবিত ছিলেন)।
৩.২. ছাতকে ১৭ মুক্তিযোদ্ধার হত্যাকাণ্ড
১৮ জন যুবক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়ে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে।
তাদের মধ্যে ১৭ জনকে ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ রাস্তার পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৩.৩. মুক্তিবাহিনীর সফল অপারেশন
কুমিল্লা: চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদিঘি ক্যাম্পে হামলা করে পাকিস্তানি সহযোগী আব্দুল হামিদ (সাবেক এমপিএ) ও আব্দুস সাত্তারকে নিহত করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: উজানিশার সেতুতে হামলা করে ১৩ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
কুড়িগ্রাম: কালুরঘাটে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সংঘর্ষে ২ সেনা নিহত।
৪. চীন ও পাকিস্তানের অবস্থান
করাচিতে চীনা কনসাল জেনারেল কুন চি বলেন, ‘চীন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সামরিক সহায়তাও দেবে।’
পাকিস্তান সরকার প্রচার করে যে, ‘বাংলাদেশে শান্তি ফিরেছে,’ যা ছিল মিথ্যা।
২৬ মে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বহুমাত্রিক তাৎপর্য বহন করে-
আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের গণহত্যার নিন্দা।
ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতি।
বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ও হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা।
কবি নজরুলের জন্মদিনে বাঙালির সংস্কৃতি ও সংগ্রামের ঐক্য।
এই দিনটি প্রমাণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি সশস্ত্র সংগ্রামই ছিল না, বরং এটি ছিল একটি গণআন্দোলন, কূটনৈতিক লড়াই এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধেরও ইতিহাস।
সূত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র (সপ্তম-চতুর্দশ খণ্ড)
দৈনিক পূর্বদেশ, ২৭ ও ২৮ মে ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ২৭ মে ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস
দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ মে ১৯৭১
মন্তব্য করুন