১৯৭১ সালের ২৫ মে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পুনরায় সম্প্রচার শুরু করে, ভারতের সংসদে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অপারেশন অব্যাহত থাকে। নিচে দিনটির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো:
১. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পুনঃসম্প্রচার শুরু
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয়/তৃতীয় পর্যায়ের সম্প্রচার ২৫ মে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। কলকাতার বালিগঞ্জের ৫৭/৮ নম্বর একটি দোতলা ভবনে এই বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও ও অফিস স্থাপন করা হয়। তবে ট্রান্সমিটারটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে একটি গোপন স্থানে বসানো হয়েছিল, যা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) নিয়ন্ত্রণ করত।
প্রথম পর্যায়: ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল, কিন্তু ৩০ মার্চ পাকিস্তানি বিমান হামলায় তা বন্ধ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় পর্যায়: মে মাসের শেষ দিকে কলকাতা থেকে পুনরায় সম্প্রচার শুরু হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা ও মনোবল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২. ভারতের সংসদে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা
২৫ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী দলীয় নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন।
লোকসভায় বিতর্ক সময় বরাদ্দ: লোকসভায় ৪ ঘণ্টা ও রাজ্যসভায় ৫ ঘণ্টা বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়।
অটল বিহারী বাজপেয়ী (জনসংঘ নেতা): বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
অশোক কুমার সেন (সাবেক আইনমন্ত্রী): বাংলাদেশের সংগ্রামের ন্যায্যতা তুলে ধরে স্বীকৃতির পক্ষে মত দেন।
জে. বি. পট্টনায়েক (নব কংগ্রেস): বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানান।
ত্রিদিব কুমার চৌধুরী (আরএসপি): পাকিস্তানের দমননীতির নিন্দা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য: রাজ্যসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারতের কোনো দ্বিধা নেই, তবে কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে:
বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু?
আন্তর্জাতিক সমর্থন কেমন?
পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব কী হবে?"*
তিনি আরও বলেন, “পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের ঢল ভারতের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান যদি শান্তি ফিরিয়ে না আনে, ভারতকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।”
৩. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও শরণার্থী সমস্যা
ব্রিটিশ জাহাজ থেকে বাঙালি নাবিকের পলায়ন: কলকাতা বন্দরে নোঙর করা ব্রিটিশ জাহাজ এসএল কুইলারা-এর একমাত্র বাঙালি নাবিক আমির আহমেদ পশ্চিম পাকিস্তানি নাবিকদের বাধা উপেক্ষা করে জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপ দেন ও ভারতে আশ্রয় নেন।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া: ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে পাকিস্তান ভারতীয় হাইকমিশনারকে চিঠি দেয়, যাতে বলা হয়, “ভারত যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করছে।”
৪. পাকিস্তানি বাহিনীর দমন-পীড়ন
রংপুরে গণহত্যা: পাকিস্তানি সেনারা রংপুরের গুপ্তপাড়া ও আশেপাশের এলাকা থেকে ৫০ জন বাঙালিকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে হামলা: মেঘালয়ের ঢালুবাজারে পাকিস্তানি সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে গুলি চালালে ২২ জন নিহত হন (৯ জন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী)।
আসামের করিমগঞ্জে হামলায় কয়েকজন আহত হন।
প্রেস সেন্সরশিপ: পাকিস্তানের উর্দু পত্রিকা আজাদ-এর সম্পাদক আবদুল মালিককে ইয়াহিয়া খানের সমালোচনার জন্য ১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
৫. মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অপারেশন
কুমিল্লার জোড়কাননে: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ২০ জন সৈন্য হত্যা করে।
নরসিংদী: মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আবদুল মজিদকে হত্যা করে।
রেলপথে সাবোটাজ: পার্বতীপুর-জয়পুরহাট রেললাইনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্রেনে বিস্ফোরক হামলা চালানো হয়।
রাজশাহী পাওয়ার হাউসে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত করা হয়।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়।
৬. রাজনৈতিক বিবৃতি ও শান্তি কমিটি গঠন
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়: পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বিবৃতি দেন।
ভৈরব শান্তি কমিটি: স্বাধীনতাবিরোধী আব্দুল মান্নান-এর নেতৃত্বে ২৭ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়।
ঢাকায় সামরিক অধ্যাদেশ: ২১ নং অধ্যাদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সামরিক শাসকদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (৫ম, ৭ম, ৮ম, ৯ম, ১২শ খণ্ড)
দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ মে ১৯৭১
দৈনিক পূর্বদেশ, ২৬ মে ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ২৬ মে ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর (ভারত), ২৬ মে ১৯৭১
মন্তব্য করুন