ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২২ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
২২ মে ২০২৫, ০৯:৫৬ পিএম
২২ মে ২০২৫, ১০:০৭ পিএম
এপ্রিল ১৯৭১, ভারতীয় সীমান্তের কাছে একটি পর্যবেক্ষণ পোস্টে মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা | ছবি: অ্যান ডি হেনিং মুক্তি বাহিনীর সাথে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে হেনিং বলেছিলেন-“আমি দেখলাম একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধা তাদের অস্থায়ী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসছে, যার পাশে উড়ছে সবুজ-লাল-সোনালী রঙের পতাকায় সজ্জিত একটি লম্বা বাঁশের খুঁটি। তারা আমাকে প্রশস্ত হাসি দিয়ে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘আপনি এখন স্বাধীন বাংলাদেশে!’”
এপ্রিল ১৯৭১, ভারতীয় সীমান্তের কাছে একটি পর্যবেক্ষণ পোস্টে মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা | ছবি: অ্যান ডি হেনিং মুক্তি বাহিনীর সাথে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে হেনিং বলেছিলেন-“আমি দেখলাম একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধা তাদের অস্থায়ী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসছে, যার পাশে উড়ছে সবুজ-লাল-সোনালী রঙের পতাকায় সজ্জিত একটি লম্বা বাঁশের খুঁটি। তারা আমাকে প্রশস্ত হাসি দিয়ে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘আপনি এখন স্বাধীন বাংলাদেশে!’”

সীমান্ত গান্ধীর মধ্যস্থতা প্রস্তাব ও পাকিস্তানের নীরবতা পাখতুন নেতা খান আবদুল গাফফার খান (সীমান্ত গান্ধী) আফগানিস্তানের কাবুল থেকে বিবৃতি দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা করার প্রস্তাব দেন। তিনি পাকিস্তান সরকারকে জানান, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার্থে তিনি মধ্যস্থতাকারী হতে প্রস্তুত। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কোনো সাড়া দেয়নি। তাঁর বিবৃতির অনুলিপি ২২ মে দিল্লিতে সাংবাদিকদের কাছে বিতরণ করা হয়।

সীমান্ত গান্ধী তাঁর বিবৃতিতে উল্লেখ করেন

"পাকিস্তানের ধ্বংসদশা ভুট্টো ও কাইয়ুম খানের ভুল নীতির ফল।"

"৬ দফা যদি বিপজ্জনক হয়, তাহলে সামরিক সরকার শুরুতে কেন এটি বাতিল করেনি?"

"বাঙালিরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল চালিকাশক্তি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতি এই অন্যায় কেন?"

"পাঞ্জাবের পুঁজিপতি ও সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার বন্ধ করুন।"

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গণহত্যার প্রতিবাদ

১. দ্য স্যাটারডে রিভিউ-এর প্রতিবেদন:

"পূর্ব পাকিস্তান এখন একটি অনুমোদিত বধ্যভূমি।"

"১৯৭০-এর নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসনের রায়কে সামরিক শক্তি দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।"

২. ন্যাশনাল হেরাল্ড (ভারত):

আগরতলা জেনারেল হাসপাতালে শরণার্থীদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার চিত্র প্রকাশ।

১৩ বছর বয়সী এক শিশু ও ৯ বছর বয়সী এক মেয়ে পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে চোখের দৃষ্টি হারায়।

৩. হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড:

করিমগঞ্জ সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের সমাবেশের খবর প্রকাশ।

৪. মার্কিন দূতাবাসের গোপন চিঠি:

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সরবরাহকৃত অস্ত্র বাঙালি নিধনে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে উল্লেখ।

ভারতের অবস্থান ও শরণার্থী সংকট

ইন্দিরা গান্ধী: "পাকিস্তানে হস্তক্ষেপ নয়, কিন্তু শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে।"

জগজীবন রাম (প্রতিরক্ষামন্ত্রী): করিমগঞ্জ ও হলদিবাড়ী শিবির পরিদর্শন করে সতর্ক করেন, "পাকিস্তানি গোলাবর্ষণ চলতে থাকলে, ভারত প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে।"

জনসংঘ (ভারতের বিরোধী দল): বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিন্দা করার সিদ্ধান্ত।

বাংলাদেশে গণহত্যা ও প্রতিরোধ

১. ভীমনালি গণহত্যা (পিরোজপুর) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার-এর নেতৃত্বে ৫০০ রাজাকার হিন্দু-অধ্যুষিত ভীমনালি গ্রাম ঘেরাও করে।

২ ঘণ্টার যুদ্ধে ১৫ জন গ্রামবাসী নিহত, রাজাকার লালু খান নিহত।

৮০টি বাড়ি লুট ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

২. শরীয়তপুরে তাণ্ডব

পাকিস্তানি সেনারা একাধিক গ্রামে হামলা করে নির্বিচারে হত্যা চালায়।

৩. ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান

শালদা নদীতে ক্যাপ্টেন আবদুল হকের নেতৃত্বে হানাদার ঘাঁটি আক্রমণে ৪ সেনা নিহত।

নালিতাবাড়ি ব্রিজ ধ্বংস করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

৪. রাজাকার-আলবদরের তৎপরতা

চট্টগ্রামে নেজামে ইসলামীর সভায় "সেনাবাহিনীকে সহায়তা করাই ধর্মীয় দায়িত্ব" ঘোষণা।

রংপুরে সাবেক এমএনএ সিরাজুল ইসলাম সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিবৃতি দেন।

মুক্তিসংগ্রামের সংগঠন ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

কলকাতায় বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়:

সভাপতি: এ আর মল্লিক (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)।

সদস্য: জহির রায়হান, সৈয়দ আলী আহসান, কামরুল হাসান, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ।

সূত্র ১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (৭ম-১৩শ খণ্ড)। ২. দৈনিক পাকিস্তান, ২৩ মে ১৯৭১। ৩. দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ মে ১৯৭১। ৪. দ্য স্যাটারডে রিভিউ, ন্যাশনাল হেরাল্ড (আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন)।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১০

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১১

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১২

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৩

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৪

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৫

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৬

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৭

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

১৮

৩০ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট

১৯

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা দেশ কখনোই সভ্য হতে পারে না

২০