ঢাকা রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

সোহরাওয়ার্দী একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বন্ধুত্ব চেয়েছিলেন

আলতাফ পারভেজ
প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম
হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার স্বাগত জানাচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন সোহরাওয়ার্দীকে, ১৯৫৭ ছবি: থমাস জে হালোরান
হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার স্বাগত জানাচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন সোহরাওয়ার্দীকে, ১৯৫৭ ছবি: থমাস জে হালোরান

পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাবের নাম নিশান-ই-পাকিস্তান। ১৯৫৭ সালে এটা প্রবর্তন করা হয়। সে বছরই এটা দেয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪তম প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে। এ থেকে পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সম্পর্কে অল্প হলেও ধারণা মেলে।

আইজেনহাওয়ার ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৫৩-৬১ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে একবার মন্ত্রী, আরেকবার প্রধানমন্ত্রী (সেপ্টেম্বর ১৯৫৬অক্টোবর ১৯৫৭) ছিলেন। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় ছিল এটা।

পাকিস্তানের ইতিহাসে সোহরাওয়ার্দী বিশেষভাবে আলোচনায় আসেন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এবং উত্তপ্ত এক বিতর্কে পড়েন তার যুক্তরাষ্ট্রপন্থী অবস্থানের কারণে। বিদেশনীতিতে তিনি মধ্যপন্থার বিরোধী ছিলেন।১ তিনি মনে করতেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থাকা। এ রকম নীতির পক্ষে খোলামেলা বক্তব্য দিয়ে তিনি রাজনৈতিক পরিসরে বেশ বিপদে পড়েছিলেন। বরাবরই পাকিস্তানের বিদেশনীতির একটা কৌতুককর দিক ছিল এখানে প্রায় সব শাসক গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের মদদ চাইতেন, কিন্তু প্রকাশ্যে জনতার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কথা বলতেন, কারণ সেটা ছিল লোকরঞ্জনের ভালো উপায়। অথচ সোহরাওয়ার্দী নিলেন উল্টো ধরনের অবস্থান। নীতির প্রশ্নে তিনি সচরাচর লুকোচুরি করতেন না, এমনকি সঙ্গীহীন দশায়ও।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীর বিপরীতে পাকিস্তানকে শক্তিশালী বিদেশী বন্ধু খুঁজতে হয়েছে। তখনকার পাকিস্তানের কুলীন শ্রেণী (ruling elites) শিক্ষায়, সম্পদশালী হওয়ার ধরনে এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসে পশ্চিমা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বকেই সম্ভাব্য মিত্র হিসেবে ভেবেছে। জিন্নাহসহ মুসলিম লীগের নেতৃত্ব পর্যায়ের প্রভাবশালী অধিকাংশ চরিত্র ছিলেন সমাজতন্ত্রবিরোধী। যদিও দেশটির নিচুতলায় বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত ছিল।

পাকিস্তান বন্ধু হিসেবে প্রথমে পুরনো প্রভু ব্রিটেনকেই পেতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছু ঐতিহাসিক তিক্ততায় সেটা হয়নি। এর মাঝে ছিল স্বাধীনতার পর লর্ড মাউন্টব্যাটনকে প্রথম গভর্নর না করার তিক্ততা। ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রত্যাশিত মাত্রায় গতি না পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধান পছন্দ হয়ে ওঠে। জিন্নাহ যে তার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক বন্ধু আবুল হাসান ইস্পাহানিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন তাও দেশটির কাছে বড় ধরনের প্রত্যাশা থেকে।

পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরও সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা ছিল। তারা রুশদের দিক থেকে আসা সাম্যবাদী তরঙ্গ সামাল দিতে পাকিস্তানকে প্রয়োজনীয় মনে করেছিল। অর্থাৎ পারস্পরিক নিরাপত্তা স্বার্থ এবং সাম্যবাদ বিরোধিতা মুসলিম লীগ ও সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের ঐক্যের একটা জমিন তৈরি করে।

তবে জিন্নাহ কিংবা লিয়াকত আলী খানের আমলে এ চেষ্টা বিশেষ সফল হয়নি। কারণ প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্র্যুমানের আমলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ওয়াশিংটন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিল ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে শক্তিশালী করে তোলার ওপর নয়। আইজেনহাওয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এ অবস্থা বদলায়। বিশেষ করে ভারতে নেহরু প্রশাসনের সোভিয়েতমুখী দৃঢ় অবস্থান এবং কোরিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রতি করাচির শাসকদের সমর্থনে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের দিকে বাড়তি মনোযোগ দিয়ে তাকাতে শুরু করে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দীই প্রথম প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বকে জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে শুরু করেন। তার এ অবস্থানের পক্ষে তিনি আওয়ামী লীগকেও শামিল করতে গেলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে দলটির বহুল আলোচিত সম্মেলনের পর সংগঠকদের একাংশ বেরিয়ে গিয়ে ‌ন্যাপ গঠন করেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সংগঠকরা সোহরাওয়ার্দীর যুক্তরাষ্ট্রপন্থী অবস্থান পুরোপুরি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তবে বিদেশনীতির প্রশ্নে তার অবস্থান ছিল একরোখা ও দৃঢ়। এ বিষয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের৩ দল ছেড়ে যাওয়ার উদ্যোগে তাকে সমন্বয়বাদী ভূমিকায় দেখা যায়নি। বরং অনেকটা বেরই করে দেয়া হয় তাদের। কাগমারী সম্মেলন এবং পরবর্তী সময়ে অনেকটা তিক্তভাবে এ বিভক্তিকরণ ঘটছিল। এ সম্মেলনের আয়োজন জাঁকজমকপূর্ণ করার জন্য সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু দলের ভেতরকার বামপন্থীরা সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীর বিদেশনীতির শক্ত বিরোধিতা করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। আবার সোহরাওয়ার্দীও এ সম্মেলন নিয়ে বেশ উৎসাহী ছিলেন। তিনি দেখাতে চাইছিলেন দল পুরোপুরি তার পেছনে রয়েছে।

কিন্তু কাগমারীতে নিজ দলের ভেতর থেকে বিদেশনীতি নিয়ে ওই বিরোধিতা সোহরাওয়ার্দীকে বহুভাবে দুর্বল করে। তাৎক্ষণিকভাবে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয় জাতিসংঘে। সম্মেলনকালে টাঙ্গাইলে অনেক তোরণ বানানো হয় নানাজনের নামে। একটা তোরণ ছিল পণ্ডিত নেহরুর নামে। এ সম্মেলন যখন হচ্ছিল তখন জাতিসংঘে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল শক্ত এক কূটনৈতিক যুদ্ধ চালাচ্ছিল। তার মাঝে কাগমারীতে নেহরু তোরণের সংবাদ তুলে ধরে ভারতীয় প্রতিনিধি দল জাতিসংঘে দেখাতে চাইছিল কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক এমন দাঁড়ায়নি যে জাতিসংঘকে মধ্যস্থতা করতে হবে। স্বভাবত এতে সোহরাওয়ার্দী প্রেরিত প্রতিনিধি দল বেশ বিব্রত হয়।৪ ওই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর মামাতো বোন শায়িস্তা ইকরামুল্লাহ।

কাগমারী সম্মেলন থেকে ফিরে সোহরাওয়ার্দী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে তার বিদেশনীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মৃদু কৌতুক করে বলেছিলেন: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পক্ষে অবস্থান নেয়া হলে এখানে ‍সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট’’ মনে করা হয়কিন্তু রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিলে স্বাধীনচেতা ভূমিকা হিসেবে গণ্য করা হয়।...অনেকে প্রশ্ন করেন, আমরা কেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বদলে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছি না। আমার উত্তর হলো শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে শূন্যই হবে। ‍শূন্য’’দের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেয়ে আমাদের আরো সামনে তাকানো উচিত।৫ এ রকম বক্তব্যের পর সোহরাওয়ার্দী মুসলিম উম্মাহর অপমান করেছেন বলে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। তার পদত্যাগও দাবি করা হয়।

এ ঘটনার জন্য না হলেও শিগগিরই অবশ্য সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়। তারও বড় কারণ ছিল তার যুক্তরাষ্ট্রপন্থী বিদেশনীতি। সোহরাওয়ার্দী যে বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন, সেই ১৯৫৬ সালে তার কার্যকাল শুরুর এক মাস পরই যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইসরায়েল দুই ধারায় মিসর আক্রমণ করে। মিসর সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করায় এ সংঘাতের সূচনা হয়। এ ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী হবে এ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের ভেতর ও দেশটির জনসমাজে বিতর্ক ছিল। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান মিসরের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে ক্ষুব্ধ ছিল। খোদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ মিসরের জন্য এখান থেকে সৈনিক পাঠানোর দাবি তুলল। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করছিল। দ্রুত সৈনিক দল গড়ার আয়োজন শুরু হয়। প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে এ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তবে সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে মিসর সংকটে পশ্চিমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অবস্থান নেয়ার সুযোগ ছিল না। তিনি সুয়েজ খালে বিদেশী হস্তক্ষেপের মৃদু নিন্দার অতিরিক্ত কোনো অবস্থান নেননি।

সোহরাওয়ার্দীর এ রকম অবস্থানের কারণ হলো প্রথমত, পাকিস্তান ছিল কমনওয়েলথের সদস্য। দ্বিতীয়ত, বাগদাদ চুক্তিরও অংশীদার ছিল পাকিস্তান। যে চুক্তিতে ব্রিটেন একটা পক্ষ ছিল এবং এ জোট গড়ে উঠেছিল সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টায়। তৃতীয়ত, পাকিস্তান এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সাবমেরিন ও যুদ্ধবিমানসহ নানা সামরিক সহায়তা চাইছিল। মিসর তখন কূটনৈতিকভাবে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছাকাছি। সোহরাওয়ার্দী তার দেশের সামনে সোভিয়েতদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের পক্ষ থেকে সৃষ্ট বিপদের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মন জয় করতে চেষ্টা করছিলেন। ফলে সুয়েজ সংকটে সোহরাওয়ার্দী যতটা পারা যায় মধ্যপন্থী ভঙ্গিতে থাকতে চাইলেন। কিন্তু মিসর সংগতকারণে তাতে সন্তুষ্ট ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী নাসেরের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। সোহরাওয়ার্দীর জন্য এটা একটা জটিল মুহূর্ত ছিল। পাকিস্তানের জনগণের বড় অংশ চাইছিল তাদের দেশ মিসরের পক্ষ নিক। পাকিস্তানের কৌশলগত স্বার্থ ও জনগণের পছন্দের এ বিরোধ আজও কাটেনি। এখনো দেশটির শাসক-কুলীন সমাজ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রীর জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আবার জনসমাজে পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব বেশ তীব্র। ১৯৫৭ সালে অনুরূপ টানাপড়েনের মাঝেই যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী। পূর্ব পাকিস্তানে সে সময়কার সোহরাওয়ার্দীর একজন তরুণ রাজনৈতিক সহযোগীর মতে, সফরটা ছিল জবাবদিহিমূলক। অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দীর চীন সফরে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিল।

তিনদিনের এ সফরকালে ১১ জুলাই উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সোহরাওয়ার্দী এ সময় সিনেট ও কংগ্রেস উভয় জায়গায় বক্তব্য রাখেন। ১৩ জুলাই উভয় প্রেসিডেন্টের যে যুক্ত ঘোষণা প্রকাশিত হয় তাতে সাম্যবাদকে তারা মুক্ত বিশ্বের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে অভিহিত করেন।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো প্রধানমন্ত্রী হয়ে সোহরাওয়ার্দী যুক্তরাষ্ট্রের আগে সাম্যবাদী চীনেই গিয়েছিলেন, প্রথমে ১৯৫৬ সালের ১৯ অক্টোবর। দীর্ঘ আটদিনের সফর ছিল এটা। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো নেতার এটাই ছিল চীনে প্রথম সফর। এর দুই-তিন মাস পর ২৮ ডিসেম্বরে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইও পাকিস্তানে আসেন ১০ দিনের এক সফরে।৬ এর মাঝে চীনের নেতা তিনদিন পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ডক্টর অব ল ডিগ্রি দেয়া হয়।

১৯৫১ সালে চীন ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও সোহরাওয়ার্দীর আমলেই পারস্পরিক এ রকম সফর শুরু হয়। সোহরাওয়ার্দী যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন প্রতিবেশী ভারত, চীন, আফগানিস্তান কারও সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ ছিল কম। কিন্তু বাকি প্রতিবেশী বা আশপাশের অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ ছিল এবং প্রয়োজনও ছিল। সোহরাওয়ার্দী দ্রুত আফগানিস্তান ও চীনে যান। চীন আসা-যাওয়ার পথে সোহরাওয়ার্দী বার্মায়ও দুই দফা যাত্রাবিরতি করেন এবং সেখানকার নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তানের সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে তিনি খুবই অগ্রাধিকার দিচ্ছিলেন।

সোহরাওয়ার্দী বিশেষভাবে চীনের পাশাপাশি আমেরিকাকে কাছে টানতে চাইছিলেন যেকোনো মূল্যে। সে কারণেই চৌ এনলাই পাকিস্তান আসার ছয় মাস পর ১৯৫৭ সালের ১০ জুলাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রেও যান।

সম্প্রতি অবমুক্ত নানা ধরনের দলিলে ওয়াশিংটনে সোহরাওয়ার্দীর তিনদিনের সফরকালে চাওয়া-পাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। যাতে দেখা যাচ্ছে, সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে সোহরাওয়ার্দী যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের পাশে রাখতে আগ্রহী ছিলেন। এ সময় সোহরাওয়ার্দী প্রশাসন পাকিস্তানের পেশোয়ারে গোয়েন্দা স্থাপনা গড়ার অনুমতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রকে। সমালোচকরা একে স্পাই ইন দ্য স্কাই চুক্তি বলছিল। এ চুক্তির বলে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান থেকে ওয়াশিংটন মধ্য এশিয়ায় রুশদের কর্মকাণ্ডে উচ্চপ্রযুক্তির মাধ্যমে নজর রাখতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এটা ছিল বড় এক কৌশলগত প্রাপ্তি। সোহরাওয়ার্দী এ চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানকে মোটাদাগে যুক্তরাষ্ট্রের এক সামরিক সহযোগিতে পরিণত করতে চাইছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে এ সফরের সময় সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার কন্যা বেগম আখতারও ছিলেন। চীন সফরেও তাকে রাখা হয়। এ থেকে মনে হচ্ছিল কন্যাকেও তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রশিক্ষিত করতে চাইছিলেন। এ সময় আইজেনহাওয়ারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডুল্লেস পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র নৈকট্য তৈরিতে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখছিলেন। কমিউনিস্ট আদর্শবিরোধী খুবই আগ্রাসী চরিত্র ছিলেন তিনি। তার ভাই অ্যালেন ডুল্লেস এ সময় সিআইএর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

রাজনৈতিক সহযোগীদের অনেকের বিরাগের শিকার হয়েও সোহরাওয়ার্দী এ সময় পাকিস্তানের সিয়াটো (SEATO) ও সেনটো (CENTO) জোটভুক্তির পক্ষে ছিলেন। তিনি এগুলোকে ‌কল্যাণকর মনে করতেন।৭ প্রথমটি গঠন হয় ১৯৫৪ সালে, পরেরটি পরের বছর। এর মাঝে ১৯৫৪ সালের ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহায়তা চুক্তিও হয়। যার ফল হিসেবে কয়েক মিলিয়ন ডলারের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম পায় পাকিস্তান। এর পর পরই পাকিস্তান ওই জোট দুটিতে যুক্ত হয়। ১৯৫৭ সালের ৩ মে সোহরাওয়ার্দী ফিলিপাইনের পার্লামেন্টের যুক্ত অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে সিয়াটো গঠনকে জাতিসংঘ সনদসম্মত বলেও অভিহিত করেন। পাকিস্তানকে সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের তীব্র সমালোচনা করছিল এ সময় ভারত। যদিও তারা রুশদের সহায়তা নিচ্ছিল উদারভাবে।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রপন্থী বিভিন্ন জোটে যুক্ত থেকে পাকিস্তানের নেতৃত্ব মূলত চেষ্টা করছিলেন ভারতের বিপরীতে দেশটির সামরিক নিরাপত্তা বাড়াতে। অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী জাতীয় প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। কাশ্মীর বিষয়ে ভারতের অবস্থান সবসময় পাকিস্তানের সামনে একটা সামরিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রেখেছিল। পাকিস্তানের ভারতভীতির প্রধান কারণ ছিল কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিভিন্ন তৎপরতা। সোহরাওয়ার্দীর সময়ও এ বাস্তবতা বিরাজ করছিল। কিন্তু সিয়াটো ও সেনটোতে পাকিস্তানের যুক্ত হওয়া দেশটির বামপন্থী ও মধ্যপন্থী মহলে তীব্র বিরোধিতায় পড়ে। এতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়।

রাজনৈতিক জীবনে সোহরাওয়ার্দী নীতিগত বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তিনটি ভাষণ দেন তার প্রত্যেকটিতে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে এটা বলতেন যে ভারত একটা বড় দেশ, বিপুল সম্পদশালী। এ দেশকে পাকিস্তানের পক্ষে শত্রু বলে বিবেচনা করা সম্ভব নয়। সেটা বুদ্ধিমানের কাজও হবে না। তবে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের সুযোগ করে নিতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়তে হবে পাকিস্তানকে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে তিনি যে মরিয়া হয়ে সম্পর্ক গড়তে চাইছিলেন, সেটা মূলত ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সামরিক ভারসাম্যের জন্য। এটাই ছিল তার যুক্তি। এ ব্যাপারে তার অবস্থান বিতর্কযোগ্য হলেও ছিল বেশ স্বচ্ছ। তার ভাষায়, আমরা নিজেদের রক্ষা করার মতো যথেষ্ট বড় নই। যথেষ্ট শক্তিশালী নই। আমাদের অন্যদের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য চাইতে হয়। কারণ আমাদের সংগতি নেই।

কেবল সিয়াটো ও সেনটোর প্রতি পক্ষপাত নয়, আফগানিস্তানকেও সোভিয়েত প্রভাব থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী। এটা ছিল তার দিক থেকে এক উচ্চাভিলাষী ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপ। কারণ সোহরাওয়ার্দী যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন উভয় দেশে পরস্পরের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন অনুপস্থিত। ১৯৫৫ সালে কাবুলে পাকিস্তান দূতাবাসে স্থানীয়দের আক্রমণের পর উভয় দেশের সম্পর্ক একেবারে শীতল হয়ে পড়েছিল। এ শীতলতার আরেকটি কারণ ছিল ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের জাতিসংঘ ভুক্তিতে আফগানিস্তানের বিরোধিতা। আফগানিস্তান ছিল একমাত্র মুসলমান প্রধান দেশ, যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ রকম অবস্থান নিয়েছিল। আবার ১৮৯৬ সালে সৃষ্ট ডুরান্ড লাইন নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের বিরোধ ছিল। এতসব তিক্ততার মাঝেও সোহরাওয়ার্দীর আমলে উভয় দেশের সম্পর্ক বেশ ইতিবাচক মোড় নেয়। সোহরাওয়ার্দী পারস্পরিক সম্পর্ককে চাঙ্গা করেন, উভয় রাজধানীতে রাষ্ট্রদূতদের ফিরে আসার ব্যবস্থা করেন। ১৯৫৭ সালের জুনে তার কাবুল সফরের ভেতর দিয়ে উপরিউক্ত অবস্থা তৈরি হয়। এ বছরের অক্টোবরেই দুই দেশের ভেতর একটা বিমান চুক্তি হয়। আফগান প্রধানমন্ত্রী দাউদ খানও পাকিস্তানে আসেন।

সোহরাওয়ার্দীর আফগাননীতির সফলতা যুক্তরাষ্ট্রের আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের পছন্দনীয় ছিল। আফগানিস্তানকে তারা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের কাছাকাছি দেখতে চাইছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ক্ষমতা থেকে সোহরাওয়ার্দীর উৎখাত ও তার বন্দিত্ব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যত কিছু করেনি। কারণ সম্ভবত তার গণচীন নীতি। যুক্তরাষ্ট্রমুখী নীতিগত অবস্থানের কারণে তিনি অজনপ্রিয় হলেও চীনের সঙ্গে তার আমলে সম্পর্কের নাটকীয় উন্নয়নে নাগরিকরা খুব খুশি হয়। কিন্তু এ নাগরিক সমর্থন তার ক্ষমতাচ্যুতি আটকাতে পারেনি।

সোহরাওয়ার্দীর চীননীতি এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে অনুমান করা হয় যে ওয়াশিংটনের কর্তাদের কাছে তখনো চীনের সাম্যবাদী ধরন একটা ভীতির বিষয় ছিল এবং তাদের নীতিনির্ধারকদের মাঝে সাম্যবাদ নিয়ে স্পর্শকাতরতা ছিল ভয়াবহ মাত্রায়। সোহরাওয়ার্দী এক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাসী থাকলেও সেটা পেরেছেন বলে মনে হয় না। অন্তত তার ক্ষমতাচ্যুতি সেটাই প্রমাণ করে। কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো পাকিস্তানের এখনকার অনেক শাসকও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে ধরাশায়ী হয়ে চলেছেন।

সোহরাওয়ার্দী যেটা বিশ্বাস করতেন এবং এখনো পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে যে বিশ্বাসের গভীর প্রভাব রয়েছে তা হলো কাশ্মীর প্রসঙ্গ অমীমাংসিত রেখে বিশাল ভারতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে হলে পাকিস্তানের যেমন চীনকে প্রয়োজন, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সহায়তাও দরকার। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগের বছর সোহরাওয়ার্দীর চীন সফর ওই রকম বিবেচনা থেকেই পরিকল্পিত ছিল। এ পরিকল্পনা শুরুতে ভালোভাবে কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু আইজেনহাওয়ারের ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তাননীতি পাল্টায় ও সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। কারণ পাকিস্তান যতই ভারতের বিরুদ্ধে নিজের সামরিক সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পেতে চেয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তত পাকিস্তানকে চেয়েছে কেবল রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে। আইজেনহাওয়ারের দ্বিতীয় মেয়াদের (১৯৫৬-৬১) শেষে যে ধরনের পদক্ষেপে ভারতের আপত্তি থাকতে পারে, দক্ষিণ এশিয়ায় সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো বিরত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ আবারো ট্রুম্যানের দৃষ্টিভঙ্গি; ফিরে আসে ওয়াশিংটনের নীতিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের উত্থান-পতনের ওই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন ওই সম্পর্ককে স্থিতিশীলতা দিতে। রাজনীতিতে তার ভূমিকার পক্ষ-বিপক্ষ থাকলেও বিদেশনীতির প্রশ্নে পাকিস্তান তার পদক্ষেপগুলোকে আজও এক স্থায়ী দিশা হিসেবে অনুসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আফগানিস্তানকে একই সঙ্গে কাছে রাখার চেষ্টা করছে তারা। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন ওই পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে পাশ্চাত্যের মতো গণতন্ত্রের বিকাশ। যেমনটি হয়তো চেয়েছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় বড় হওয়া জিন্নাহও। কিন্তু দুজন একসঙ্গে মিলে সে চেষ্টা করতে পারেননি।

সোহরাওয়ার্দী এশিয়ার এ অঞ্চলে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বন্ধু হিসেবে নয় বরং ইউরোপ-আমেরিকার ধাঁচে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলাকে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার একটা শর্ত মনে করতেন। অর্থাৎ তার বিদেশনীতি কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্য পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসারী হয়ে থাকার ওপর নির্মিত ছিল না। তিনি ইউরোপ-আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পাকিস্তানে অনুসরণের পক্ষে ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর এ রকম ভাবনা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ১৯৫৭ সালের এপ্রিলে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে লেখা তার Political Stability and Democracy in Pakistan শিরোনামের লেখায়। তবে এ দৃষ্টিভঙ্গির সামনে ব্যবহারিক সমস্যা ছিল। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দেশটির বেসামরিক শাসনকাঠামোকে শক্তিশালী করতে পারছিল না এবং গণতন্ত্রের বিকাশেও তা ইতিবাচক কোনো অবদান রাখতে পারেনি। বরং সেটা এমন এক শক্তিশালী সামরিক আমলাতন্ত্র তৈরি করে, যা রাষ্ট্রের অন্যান্য বেসামরিক শাখার সঙ্গে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা ঘটায়। ফল হিসেবে আমরা দেখি, ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতার পর গত ৭৬ বছরের ৩৩ বছর কেটেছে দেশটির সামরিক শাসনে। এর বাইরে আরো তিনবার অন্তত অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সোহরাওয়ার্দীর জীবদ্দশায়ই ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় এ আদি পাপের শুরু। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কাছে রাখতে গিয়ে নানাভাবে সহায়তা করলেও দেশটিতে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার ব্যাপারে সামান্যই উৎসাহ দেখিয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যাওয়া সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তার শিকার।

তথ্যসূত্র

১. দেখুন, ১৯৫৭ সালের ১৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণ।

২. বাস্তবে, জিন্নাহ পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার আগেই ১৯৪৬ সালে ইস্পাহানিকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে সেখানকার গণসংযোগের কাজ সারছিলেন। ইস্পাহানির পাশাপাশি এ বিষয়ে জিন্নাহ বেগম জাহানারা শাহনেওয়াজকেও কাজে লাগান।

৩. পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপের মতোই পাকিস্তানের পশ্চিম অংশেও সোহরাওয়ার্দীর বিদেশনীতির কিছু বিরোধিতা ছিল। সেখানে এ রকম বিরোধিতায় এগিয়ে ছিল আজাদ পাকিস্তান পার্টি। গণপরিষদে এ দলের সরদার শওকত হায়াত খান ও মিয়া ইফতেখারউদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর বিদেশনীতির তীব্র সমালোচনা করতেন।

৪. নেহরু যে বাংলা ভাগের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, সেটাও কাগমারী সম্মেলনের আয়োজকরা বিবেচনায় নেননি বলেই তখন মনে হয়েছিল। নেহরু তোরণ নিয়ে জাতিসংঘে কী ঘটে সে বিবরণ দিয়েছেন সেখানে থাকা তখনকার পাকিস্তানের কূটনীতিবিদ কামরুদ্দীন আহমদ। বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, প্রথমা, ২০১৮, পৃ. ৯৯।

৫. মোহাম্মদ তোয়াহা, স্মৃতিকথা, সংস্কৃতি, ২০১৬, পৃ. ২৬২।

৬. এ সফরের সময় চৌ এনলাই পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ঢাকায় বেশি উষ্ণ সংবর্ধনা পান। এর একটা কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দী পক্ষীয় অনেক রাজনীতিবিদ ১৯৫২ সালে চীন ঘুরে এসেছিলেন এবং পাকিস্তানের এ অংশে চীনপন্থী রাজনীতির বিশেষ প্রভাব ছিল। ঢাকায় চৌ এনলাইকে ‌এশিয়ার ভবিষ্যৎ নেতা বলে সংবর্ধনা দেয়া হয়।

৭. যদিও দুটি চুক্তিই হয় সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে কিন্তু তিনি এ চুক্তিগুলোর পক্ষ নেয়া মাত্র চুক্তিবিরোধীদের ক্ষোভের শিকার হচ্ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদে (তখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী) যখন এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়, তখন সোহরাওয়ার্দী বলছিলেন, ‌এ চুক্তিগুলো আমাদের সুফল দান করছে। এগুলো পাকিস্তানের জন্য কল্যাণকর।...আন্তর্জাতিক পরিসরে নিরপেক্ষতা বা বিচ্ছিন্নতা পাকিস্তানের নীতি হতে পারে না। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৭।

[রচনাটি লেখকের লেখকের সোহরাওয়ার্দী ও বাংলায় মুসলমানের রাষ্ট্রসাধনা (২০২৪) গ্রন্থ থেকে অনুমতিক্রমে এখানে সংকলিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তথ্যসূত্রের জন্য মূল বই দ্রষ্টব্য]

প্রথম প্রকাশ : বণিক বার্তা

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১০

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১১

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

১২

জনগণ আসলে কী চায়

১৩

শহীদ বুদ্ধিজীবী / সুধীর চন্দ্র মজুমদার

১৪

শহীদ বুদ্ধিজীবী / মহসিন আলী

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আবুল বাশার মহিউদ্দিন আহম্মদ

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / ফাদার লুকাশ মারান্ডি

১৭

বুরুঙ্গা গণহত্যা: ৯৪ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা

১৮

২৬ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল দিন

১৯

২৫ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী

২০