ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ‘দায় ও দরদ’

ড. কাজল রশীদ শাহীন
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫, ০৭:০৬ পিএম
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

নতুন আকাঙ্ক্ষা, নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যয় পূরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে চলছে নানাবিধ কার্যক্রম। গঠিত হয়েছে এক ডজনেরও বেশি সংস্কার কমিশন। সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো এ নতুনের যাত্রা কি অতীতের সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে হবে? নাকি, অতীতের যা কিছু ভালো, যা কিছু গৌরবের, যা কিছু নতুনকে নির্মাণের পথে পাথেয়স্বরূপ, সেসব নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে? নিশ্চয় দ্বিতীয়টির প্রতিই আমাদের পক্ষপাত, সেটাই প্রত্যাশিত, যৌক্তিকও বটে। এ বিবেচনায় আমাদের অতীতকে খোলা মনে পাঠ করা জরুরি ও অনিবার্য। দেখে নেয়া প্রয়োজন ওনাদের দায় ও দরদ-এর দিকগুলো, যা জাতি হিসেবে, বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশটাকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তেমনই একজন রাজনীতিবিদ, এ লেখা ওনার গণতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাত, সাংবিধানিক কাঠামোর প্রতি দুর্বলতা ও সমগ্রর প্রতি মমত্ববোধ অন্বেষণের লক্ষ্যে। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কয়েকজন স্থপতির একজন হিসেবে মান্যতা পাওয়ার দাবি রাখেন।

বঙ্গ-মানসের, বাঙালি সমাজের ভেতর-বাইরের বিভাজনকে মুছে ফেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সবকিছু মোকাবেলা করতে চেয়েছিলেন গণতন্ত্র দিয়ে, গণতান্ত্রিক পথ ও পদ্ধতিতে। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং জীবনের পুরোটা সময়ই তিনি ক্ষতাক্ত থেকেছেন, বেদনায় লীন হয়েছেন; অপবাদে আর কুৎসিত আক্রমণে জর্জরিত হয়েছেন। কিন্তু শুভবোধ থেকে বিচ্যুত হননি। উপমহাদেশে এ রকম রাজনীতিবিদ নেই, এ রকম বলার অভিলাষ বা অভিপ্রায় কোনোটাই আমাদের নেই, তবে বিরল। দায় ও দরদ দিয়ে মানুষের পাশে থাকাকেই ব্রত জ্ঞান করেছেন। সমগ্রের মুক্তির ভার দূর করাকেই জীবনের ধর্ম বলে মান্যতা দিয়েছেন। দায় ও দরদ-এর অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ এ রাজনীতিক হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি সর্বজনে গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলেও বন্দিত হয়েছেন, মান্যতা পেয়েছেন। ট্র্যাজেডি হলো যে রাজনৈতিক দর্শনকে ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ বলে জ্ঞান করা উত্তর প্রজন্মের পবিত্র দায়িত্ব, সে দর্শনের জনয়িতাকে কেউ সদর্থক অর্থে মূল্যায়ন করেননি। বিভ্রান্তি, অপবাদ ও তকমা দেয়ার নেপথ্যের কারণ কী, তা তলিয়ে দেখা-খোলতাই করার কাজটি করতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কারো আগ্রহই তেমনভাবে দেখা যায়নি।

ভারত উপমহাদেশ বিভাজিত হওয়ার পর এবং অবিভক্ত বঙ্গ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হোসেন শহীদ কিন্তু সেদিনের পাকিস্তানের পশ্চিম বা পূর্বের কোথাওই যাননি। থেকেছেন পশ্চিমবঙ্গে, নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন দাঙ্গাপীড়িতদের সেবায় এবং সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষায়। ওরকমের দেশভাগ এবং বঙ্গ বিভাজনের কোলাহলের মধ্যেও উনি চিন্তিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে যেসব মুসলমান থেকে গেলেন তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে।

সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের সর্বশেষ নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। ভারত বিভক্তির পর এ রকম একজন নেতার যে রকম মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্য তার কোনোটাই দেয়নি সেদিনের ভারত সরকার। উপরন্তু দেদার চলে নানা হয়রানি। অযৌক্তিক ও অসহনীয় করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় ওনার ওপর। এক পর্যায়ে বাধ্য হন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে আসতে। মুহূর্তে স্থগিত হয়ে যায় ওনার নেতৃত্বে-উদ্যোগে ও প্রযত্নে নেয়া কার্যক্রমগুলো। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ববঙ্গে আসার জন্য লঞ্চে চেপে বসেন। সে সময় পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দীন। সে সরকার নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ ঘাট থেকে ফিরিয়ে দেন ওনাকে। অথচ খাজা নাজিমউদ্দীন যখন অবিভক্ত বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি সে মন্ত্রিসভার বেসামরিক মন্ত্রী ছিলেন। শুধু কি তাই? নিয়ম অনুযায়ী, দুই দেশের বেশির ভাগ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। সে বিবেচনায় এবং নৈতিকতা-যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতার প্রশ্নে ওই পদে হোসেন শহীদেরই অধিষ্ঠিত থাকার কথা। কিন্তু সেসবকে থোড়াই কেয়ার করা হয়েছে। জিন্নাহর কূটচালে এবং রক্ষণশীলতা ও ঘনিষ্ঠতার কারণে খাজা সাহেব ক্ষমতায় বসে যান। তারপর খলের যে ছলের অভাব হয় না, তার যথার্থ নজির হাজির করেন তিনি। হোসেন শহীদকে ভারতের চর হিসেবে দাগিয়ে দেন এবং পূর্ববঙ্গে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

সে সময় ভারত থেকে যারাই এসেছিলেন তাদের প্রায় সবাই এ আক্রমণের শিকার হন। কিন্তু এখানকার জ্ঞানচর্চায়, রাষ্ট্র-সমাজের কোনো পর্যায়েই এসব নিয়ে কোনো সংলাপ হয়নি। অথচ দেশের প্রায় সব বর্গের মধ্যেই এ বিভাজন চর্চিত ছিল, যা উৎপাদন হয়েছে দিনের পর দিন। এসব বিভাজনই অন্যান্য ক্ষেত্রে সংক্রমিত হয় এবং আগের ও পরের বিভাজনকে নানাভাবে উৎসাহিত করে। হোসেন শহীদ এসব বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে একটা সুস্থ সুন্দর রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। এবং সে দেশের স্বপ্ন নির্মাণে নিজেকে মেলে ধরেছেন জীবনের পুরোটা সময়।

হোসেন শহীদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও রাজনীতি চর্চা এ উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বে। উনিশ শতকের শেষাশেষি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। দেশে-বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন ও রাজনীতি চর্চায় যুক্ত হন বিশ শতকের দুইয়ের দশকের শুরুতে। ছয়ের দশক শুরু হওয়ার দুই বছর পরই ওনার ইহজাগতিকতায় ইতি পড়ে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সময়টা ভারত উপমহাদেশে তো বটেই সারা পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক সময়পঞ্জি। আমাদের জন্য বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঘটনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। হোসেন শহীদ এ পর্বের সংঘটিত সময়ে উপস্থিত ছিলেন না। ওনার মৃত্যু হয়েছে তারও প্রায় এক দশক আগে। কিন্তু অনুপস্থিত থেকেও এ পর্বেরও গুরুত্বপূর্ণ একজন অনুঘটক ছিলেন তিনি।

আমরা জানি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক ও প্রশাসকরা ওনাকে রুখতে নানা ছলের আশ্রয় নিয়েছিল। গুপ্তচর বলে দাগিয়ে দিয়েছিল। সে পাকিস্তানের রাষ্ট্রেরই পরবর্তী সময়ে উনি প্রথমে আইনমন্ত্রী এবং পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এবং এসবের সবটাই সম্ভব হয়েছিল ওনার রাজনীতির প্রতি প্রগাঢ় প্রেম ও গণতন্ত্রের প্রতি গভীরতর শ্রদ্ধাবোধ থেকে। যার মধ্য দিয়ে প্রকৃতার্থে উচ্চকিত ছিল দেশ ও মানুষের প্রতি দায় ও দরদ-এর নিবেদন। তিনি সর্বদাই সাংবিধানিক শাসনে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকে যতটুকু গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। সাংবিধানিক কাঠামোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা জারি থেকেছে। তার সবটায়ই হোসেন শহীদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেবল ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে থেকে নয়, এর বাইরে থেকেও এসব প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যতটুকু করণীয় তার সবটাই করেছিলেন তিনি। বিরোধী দলেও থেকেও যে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সুস্থ রাজনীতি করা যায় তারও দৃষ্টান্ত হাজির রেখে গেছেন।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো রাজনীতিবিদদের একই ছাতার নিচে আনার ক্ষেত্রে এবং জোট গঠনের প্রশ্নে যাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য ছিল, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। মুসলিম লীগ সরকারের অন্যায়-অপকর্ম, অবিচার-অনাচার, নৈতিকতা-ন্যায্যতাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিলেন। এসবের বিরুদ্ধে পুরো পূর্ববঙ্গ ঘুরে ঘুরে প্রবল জনমত গঠন করেছিলেন। ওনার সমবায়ী চিন্তা ও সমবায়ী রাজনৈতিক কৌশলের কাছে প্রবলভাবে ধরাশায়ী হয় ক্ষমতাসীন সরকার। শুধু ক্ষমতা থেকে পড়ে না রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ। ওই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক মৃত্যুও ঘটে।

হোসেন শহীদ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হতে শুরু করে, ইনস্টিটিউটগুলোয় গণতান্ত্রিক আবহ বিরাজ করতে থাকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের প্রযত্নে উৎসাহ দেয়া শুরু হয়, তখনই নড়েচড়ে বসে পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত এলিট তথা ধুরন্ধর অভিজাত গোষ্ঠী। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর লোকজন যেমন ছিল, তেমনই ছিল ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি, সরকারের সুবিধাবাদী আমলা শ্রেণী, ধর্মের আবরণে অধর্মের কায়-কারবার করা আলেম গোষ্ঠীর একটা অংশ, সমাজের মাতব্বর শ্রেণীর ভূস্বামী গোষ্ঠী প্রভৃতি। এরা সবাই একজোট হয়। তারা পাকিস্তানে যাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয় তার জন্য হোসেন শহীদকে ক্ষমতা থেকে সরানো অনিবার্য মনে করেন। তাদের সে ধারণায় অবশ্য কোনো ভুল নেই। কারণ পাকিস্তানে যদি প্রকৃতার্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তাদের মোড়লিপনা যে খর্ব হবে তা ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। গণতন্ত্রে যেহেতু সমাজের সব মানুষের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়, মুক্ত চিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতা অগ্রাধিকার পায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে অপরিহার্য জ্ঞান করা হয়। ফলে তাদের পক্ষে যা ইচ্ছা তাই করা সম্ভব নয়। তারা চান দিনের পর দিন উত্তরাধিকার সূত্রের মতো করে তাদের মোড়লিপনা জারি থাকুক। এসব জারি রাখার জন্য প্রয়োজন অব্যবস্থাপনার চাষাবাদ করা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শিক্ষার আলো ও অধিকারবোধ থেকে বঞ্চিত রাখা। এসব বিবেচনায় দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও লোপাটের চক্রধারীরা গণতন্ত্রকে তাদের শত্রুজ্ঞান করেন। আর গণতন্ত্র শত্রু হওয়ার অর্থই হলো হোসেন শহীদকে শত্রু বা চক্ষুশূল জ্ঞান করা। এ কারণে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ওনাকে ক্ষমতা থেকে অন্যায়ভাবে সরিয়ে দেন এবং সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার মসনদে নিয়ে আসেন।

হোসেন শহীদের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বড় অংশ কেটেছে ব্রিটিশ-ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসকরা অনেকটা বাধ্য হয় শাসন কাঠামোয় কিছুটা পরিবর্তন আনতে। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ১৩ লাখের মতো ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশের হয়ে যুদ্ধ করে এবং ৭৪ হাজারের মতো সৈন্য আত্মোৎসর্গ করে। যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যুদ্ধ শেষে তারা ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেবে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি মুলো হয়ে ঝুলে থাকে যুদ্ধের পরও। কেবল রিপোর্ট আর চুক্তি করে তারা প্রতিশ্রুতি পূরণের নাটক করে। শাসন ব্যবস্থায় দ্বৈত নীতি গ্রহণের সুযোগ নেয়। এসবের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিষয়গুলো সামনে আসে। একই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদও নানারূপে হাজির হতে থাকে।

লক্ষণীয় এ সময় শাসক-প্রশাসকরা হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ বা বিভাজনের বিষয়টাও কয়েন করে। তারা এ সমস্যাকে জিইয়ে রেখে নিজেদের লাভালাভকে নিশ্চিত করতে চায়। বাঙালি রাজনীতিক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বিষয়টার নেতিবাচকতা উপলব্ধি করেন। তিনি তখন কংগ্রেসের রাজনীতির শীর্ষ নেতা। উনি মনে করেন, ভারতবর্ষে যদি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের মধ্যে দিয়েই কেবল সেটা করা সম্ভব। বিভাজন জিইয়ে রেখে মিলন বা সুস্থ দেশ ভাবনা কখনই সম্ভব নয়। এ কারণেই প্রয়োজন হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য, সম্প্রীতি ও আস্থার সহাবস্থান। এ কারণেই তিনি ১৯২৩ সালে বেঙ্গল

প্যাক্ট চুক্তি সম্পাদন করেন। সিআর দাশের এ চুক্তি সম্পাদনে এবং রাজনৈতিক চিন্তায় যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তাদের অন্যতম হলেন হোসেন শহীদ। সিআর দাশ পরের বছর ১৯২৪ সালে কলকাতা পৌরসভার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হলে ডেপুটি হিসেবে ওনাকেই বেছে নেন।

কেন সেদিন সিআর দাশ ওনাকে এ দায়িত্বে নিয়েছিলেন তার অনেক যুক্তি রয়েছে নিশ্চয়। আমরা দুটি যুক্তি হাজির করতে পারি। এক. উনার গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ও সাংবিধানিক নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। দুই. মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে পারদর্শিতা ও আমজনতার মাঝে প্রভাববিস্তারী ভূমিকা পালনের দক্ষতা। এ কারণেই সম্ভবত ব্রিটিশ শাসনের শেষ দশকে অবিভক্ত বঙ্গের শাসন কাঠামোয় উনি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠেন। সে সময় তিনটি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। উনি প্রথম ও দ্বিতীয়টির মন্ত্রিসভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তৃতীয়টি অর্থাৎ শেষটির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

হোসেন শহীন যেহেতু গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক বিধি ব্যবস্থার প্রতি দায় ও দরদি মানুষ ছিলেন। এ কারণে তিনি সমগ্রর যুক্ততাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। কারণ সমগ্রর মধ্যে দিয়েই বড় বা বৃহৎ কিছু অর্জন যেমন সম্ভব, তেমনি ধারণও সম্ভব। এ কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আগ্রহী ও পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি একদা চেয়েছিলেন অখণ্ড ভারত, যেটা ছিল সিআর দাশের স্বপ্ন, মহাত্মা গান্ধীর প্রত্যয়। পরে যখন ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়ে উঠল, তখনো তিনি অবিভক্ত বঙ্গের স্বপ্ন দেখেছেন। মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন বৃহৎ বঙ্গ বা একীভূত বাংলা। আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায়ের মতো কয়েকজন রাজনীতিককে পাশেও পেয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের রাজনীতিবিদরা বঙ্গের মানুষের আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, ভাষাচেতনা, স্মৃতিকাতরতার মতো মানববিস্তারী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও অনুষঙ্গগুলোকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে বঙ্গকেও বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত আগেই চূড়ান্ত করেছেন।

পাকিস্তান যখন বাস্তবতা তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রেও তিনি সমবায়ী ও গণতান্ত্রিক মনকে সর্বৈবভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি সবসময়ই প্রগতিশীল মনের ছিলেন। দলের আদর্শ মেনে রাজনীতি যেমন করেছেন, তেমনই কাঠামোর ভেতরে থেকেও প্রগতিশীলতাকে ধারণ করেছেন, যা কিছু ভালো গ্রহণপূর্বক তাকে আত্মীকরণের চেষ্টা করেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, সবকিছুই এ বিশ্বের সম্পদ। সেখানে সব মানুষের সমানাধিকার রয়েছে। সে সমানাধিকারের জায়গা থেকে ভালোকে গ্রহণ করার, সেসবের চর্চায় ব্রতী থাকার অনুপম এক দৃষ্টান্ত হাজির করে গেছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একসময় ওনার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সে বাস্তবতায় দুই নেতার পথও দুদিকে সরে যায়। সে সময় হোসেন শহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা নীতির কারণে। কিন্তু এ নীতি কি একেবারে অমূলক, অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য ছিল? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে এ প্রশ্নেরও সুলুকসন্ধান হওয়া জরুরি যে এসবকে প্রশ্নবিব্ধ করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সমাজতন্ত্রকে আমলে নিয়েই সেটা করা হয়েছে, নাকি খোলামনে সবকিছু যাচাই-বাছাইয়ের চেষ্টা জারি ছিল? আমরা মনে করি, হোসেন শহীদের এ অবস্থান ও নীতিকেও বিশ্লেষণ করতে হবে ওনার গণতান্ত্রিক বোধ ও সাংবিধানিক কাঠামোর প্রতি দায় ও দরদকে যথাযথভাবে অবলোকনে রেখে। হোসেন শহীদের সেদিনের অবস্থান যে যথার্থ ছিল তা বোধ করি আজকের কিংবা ইদানীং কালের বাস্তবতায় অনেক বেশি স্বচ্ছ ও যৌক্তিক। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গণতন্ত্রকে অনেক বেশি খোলতাই হওয়ার সুযোগ দেয় এবং গণতান্ত্রিক পরিসরকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। হোসেন শহীদকে পাঠ করার ক্ষেত্রে আমাদের এসব বিচার-বিবেচনা অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।

হোসেন শহীদের গণতান্ত্রিক বোধ, সাংবিধানিক কাঠামোর প্রতি দায়বদ্ধতা ও সমগ্রর কল্যাণ ভাবনায় ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গঠনের বীজমন্ত্র রয়েছে। আজকের বাংলাদেশ যে নতুন আকাঙ্ক্ষার পথে হাঁটছে তা পূরণ করতে হলে ওনাকে পাঠ করা জরুরি।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চুকনগর গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার ইতিহাস

২০ মে ১৯৭১: লাল টকটকে রক্তে ভেসে গিয়েছিল ভদ্রা নদীর পানি

১৯৭১ সালের ১৯ মে: শরণার্থী সংকট ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

শহীদ বুদ্ধিজীবী / তরফদার আতিয়ার রহমান

শহীদ বুদ্ধিজীবী / খাজা আবদুস সাত্তার

শহীদ বুদ্ধিজীবী / সুব্রত সাহা

শহীদ বুদ্ধিজীবী / বলহরি দাশ

সোহরাওয়ার্দী একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বন্ধুত্ব চেয়েছিলেন

শহীদ বুদ্ধিজীবী / ইসলাম উদ্দিন

শহীদ বুদ্ধিজীবী / উজির আলী মালিথ্যা

১০

শহীদ বুদ্ধিজীবী / খন্দকার রেজাউন নবী

১১

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আবুল কাশেম মণ্ডল

১২

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার পদ্মানদীর মাঝি

১৩

উলানিয়ার সেই কিশোর

১৪

১৮ মে ১৯৭১: পাকিস্তানের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিবাদ

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / দীনেশচন্দ্র রায় মৌলিক

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আয়েজ উদ্দিন

১৭

শহীদ বুদ্ধিজীবী / কে এম রফিকুল ইসলাম

১৮

শহীদ বুদ্ধিজীবী / বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্য

১৯

পুলিৎজার জিতল পার্সিভাল এভারেটের উপন্যাস ‘জেমস’

২০