ঢাকা রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

বাঙ্গালীর মাতৃভাষা

খাদেমোল্ এসলাম
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫, ০৬:৪৮ পিএম
আল-এসলাম পত্রিকা
আল-এসলাম পত্রিকা

মাতৃভাষার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা বুদ্ধিমান জনোচিত কাজ নহে। আমরা যে কোন ভাষাই পড়িনা কেন, তাহা মাতৃভাষার সাহায্যেই বুঝিয়া থাকি, কারণ বাল্যকাল হইতে সেই ভাষা দ্বারাই আমাদের অন্তরে কথা বুঝিবার শক্তি গঠিত হইয়া থাকে। আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদিগকে নানাদেশ ও নানা জাতিতে বিভক্ত করিয়া সৃজন করিয়াছেন এবং দেশ ও জাতি বিশেষে বিভিন্ন ভাষাও দিয়াছেন। এজন্য কাহারও লজ্জিত হওয়ার কারণ নাই। বাঙ্গালা, ইংরেজী, উর্দু ও ফারসী ইত্যাদি ভাষা অর্থাৎ আরবী ভিন্ন পৃথিবীর যাবতীয় ভাষাই মুসলমানের জন্য সমান এবং সংস্কৃত ভিন্ন অন্য সকল ভাষাই হিন্দুর জন্য সেইরূপ। মাতৃভাষার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা, বাঙ্গালী হইয়া নিজেদের মাতৃভাষা উর্দু বা আরবী বলিয়া পরিচয় দেওয়া, কিম্বা বাঙ্গালা জানি না বা ভুলিয়া গিয়াছি এরূপ বলাএই মারাত্মক রোগ কেবল এক শ্রেণীর মুসলমানের মধ্যেই দেখা যায়। তাঁহাদের এরূপ নীতি অবলম্বন করা কি বাস্তবিক পক্ষে নিতান্ত লজ্জাজনক নহে? যাহারা এরূপ আচরণ করে তাহারা যে আপন মাতা ও মাতৃভূমির প্রতি নিন্দা প্রকাশ করে এবং নিজমুখে নিজের মায়ের এবং দেশের দীনতা হীনতা জ্ঞাপন করে, তাহাতে কিছুমাত্র সংশয় নাই। বাস্তবিক পক্ষে মাতৃভাষা শিক্ষা করা এবং তাহার উন্নতি সাধন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বাঙ্গালা ভাষার উৎকর্ষ সাধন করিলে তাহা উর্দু প্রভৃতি হইতে কোন মতেই হীন হওয়ার কথা নহে। আমাদের শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য্যই তদ্বারা সম্পাদিত হইতে পারে। মায়ের কাজ মায়ের দ্বারাই সম্পন্ন করাইতে হইবে, অপরের দ্বারা তাহা কখন পূর্ণ হইবে না। এইরূপ না করার ফল এই হইয়াছে যে, আজকাল সামান্য-শিক্ষিত ব্যক্তির বাঙ্গালা বক্তৃতা শুনার জন্য যেখানে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের ভক্তিভাজন মৌলবী মৌলানা সাহেবানের আরবী-উর্দু ওয়াজ শুনিবার জন্য শীরণী, রসগোল্লা, লাড্ডু ও জিলাপী ইত্যাদি বিতরণের প্রলোভন সত্ত্বেও সভায় লোক উপস্থিত করা মহা মুস্কিল হইয়া থাকে।

মাতৃভাষার উন্নতি আমরা দুই রকমে করিতে পারি। প্রথমতঃ ঐ ভাষায় ধৰ্ম্ম সংক্রান্ত কেতাব সকল তরজমা করা এবং ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বাদশা, অলী ও দরবেশগণের জীবনচরিত ইত্যাদি লেখা। দ্বিতীয়তঃ আজকালের নূতন আবিষ্কৃত হেকমত বা জ্ঞান বিজ্ঞান ও হিসাব ইত্যাদি পার্থিব উন্নতি বিষয়ক পুস্তকাদি লিখিয়া তাহা জনসমাজে প্রচারের সুবিধা করা।

আজকাল আমাদের দেশে দুই রকমের বাঙ্গালা দেখা যাইতেছে। একটি আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃগণের অবলম্বিত সংস্কৃত বহুল শব্দ বিজড়িত বাঙ্গালা, ইহা ইংরেজ আমলদারীর বিগত শতাব্দীর গড়ান বাঙ্গালা ভাষার নূতন সংস্করণ নামে অভিহিত হইতে পারে। বর্তমান সময় অধিকাংশ শিক্ষিত মুসলমানও তাহাদের অনুকরণে ওইরূপ সাধু ভাষাজড়িত বাঙ্গালা বই পুস্তক লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এই রকম বাঙ্গালাই আজকাল স্কুলে পড়ান হয়। এই ভাষাতে বাঙ্গালীর পূর্ব্ব পুরুষগণ যে সব শব্দ কখনও শুনেন নাই, তাহা অতি অধিক পরিমাণে ব্যবহার করা হইয়াছে। এমন কি, তাহা ভালমতে বুঝার জন্য মৃত সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করা এবং ওস্তাদ ও অভিধানের সাহায্য গ্রহণ ব্যতীত উপায় নাই। বাঙ্গালার সাধারণ লোকে কখনও ঐরূপ ভাষায় কথাবার্তা বলে না। ইহাকে তাহাদের মাতৃভাষা বলা যাইতে পারে না বরং তাহা মাতৃভাষার বিকৃতি মাত্র।

অন্যরূপ বাঙ্গালা এই দেশে বহুকাল পূৰ্ব্ব হইতেই প্রচলিত আছে। তাহাতে হিন্দু এবং মুসলমান উভয়ের ধর্ম্ম ও কারবারের আবশ্যকীয় প্রায় সমস্ত শব্দের ব্যবহার ও স্থান আছে। এই ভাষাই বাস্তবিকপক্ষে এদেশের লোকের মাতৃভাষা।

এইরূপ ভাষাকে মুসলমানী বাঙ্গলা বলা ঠিক হয় না, কারণ এই ভাষায় আমরা হিন্দু মুসলমান উভয় জাতি পুরুষানুক্রমে কথা বার্ত্তা ও লেখা পড়া করিয়া আসিতেছি। কাগজ, কলম, কেতাব, আদালত, আরজী, ইন্সাফ, কুরছি, মেজ, দোয়াত, সির, সিনী, মগজ, বরতন, পেয়ালা, তস্তরী, পালং, তোষক, বালিশ, গয়রহ ইত্যাদি শব্দ আমরা উভয় সমাজে সর্ব্বদা ব্যবহার করিয়া আসিয়াছি এবং এখনও করিয়া থাকি। কিন্তু আজ ২০/২৫ বৎসর হইতে দেশের দুর্ভাগ্যবশতঃ শিক্ষা দোষে বাঙ্গালী হিন্দু ভ্রাতাদের মনে মুসলমান ভ্রাতাদের প্রতি ভালবাসা কমিয়া যাওয়ায়, তাঁহারা মুসলমানগণ হইতে পৃথক হওয়ার উদ্দেশ্যই যেন মাতৃভাষার অন্তরাঙ্গস্বরূপ পুরুষানুক্রমে প্রচলিত শব্দ সমূহের স্থলে, নূতন শব্দ ব্যবহার করত এবং তাহাকে নানা রকমের বিকৃত আবরণ দ্বারা আবৃত করিয়া তাঁহারা যেন বৃদ্ধ মায়ের এক যুবতী সতীন গড়িয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে অনুকরণ প্রিয় কতক মুসলমানও ইহার পরিণাম ফলের বিষয় চিন্তা না করিয়া মায়ের গায় কুড়াল মারিতে ত্রুটী করেন নাই। এতদিন ত মুসলমানগণ লেখা পড়ার দিকে বিশেষ কোনরূপ মনোযোগ দেন নাই। তাহাদের বাদশাহী গেলেও কিন্তু বাদশাহী খেয়াল যায় নাই এবং পূৰ্ব্বপুরুষগণের ঝুটা (উচ্ছিষ্ট) সব খাইয়া জীবন ধারণ করিতে ছিলেন। কিন্তু এখন তাহাও ফুরাইয়া যাওয়ায় উপায়ন্তর না দেখিয়া বিদ্যা শিক্ষার জন্য স্কুল পাঠশালার দিকে ছুটিয়াছেন। সেখানে যাইয়া দেখেন, তাহাদিগকে মাতৃভাষা নামে এক নূতন ভাষা শিখিতে হইবে। তাঁহাদের মা বাপের নিকট যাহা কিছু শিখিয়াছিল, তাহার অধিকাংশই সেখানে কোন কাজে লাগিবে না এবং বাধ্য হইয়া তাহা ভুলিয়া যাইতে হইবে। বাস্তবিক বিগত ২০/২৫ বৎসর মধ্যে আমরা পূর্ব্ব প্রচলিত অনেক শব্দই ভুলিয়া গিয়াছি এবং কতক নিত্য ব্যবহারের শব্দও কমাইতে শিখিয়াছি। হায়! কি দুৰ্দ্দশা! যে জাতিকে মাতৃভাষাও নূতন করিয়া শিখিতে হয়, তাহারা কি শিক্ষা ক্ষেত্রে অপর লোকদের সমানে পড়া চলাইতে পারে? এখনও সময় আছে, শিক্ষার উন্নতির সহিত হিন্দুদের বেরাদরি ভাব বাড়িতেছে, এবং শিক্ষিত মুসলমানগণও এমন এত কম নহেন যে তাঁহাদিগকে তুচ্ছ করা যায়। বলাবাহুল্য যে সকলেই এখন উন্নতির দিকে ছুটিয়াছে। এমন সুসময়ে উত্তর সমাজের লেখকগণের পক্ষে ভ্রাতৃভাবে মিলিত হইয়া এ বিষয়ে যে ক্ষেত্রে দেশের হিন্দু মুসলমান এই উভয় জাতি একত্রে সম্মিলিত হইতে পারে, মাতৃভাষাকে সেরূপ ভাবে গড়িয়া তোলা আবশ্যক, এবং আমি ভরসা করি, সকলে এই বিষয় মনোযোগী হইবেন।

এখন আমি মুসলমান লেখকদের প্রতি কয়েকটা কথা বলিতে চাই। ইঁহাদের মধ্যে যাঁহারা নূতন শিক্ষা পাইয়াছেন, তাঁহারা প্রায়ই সংসর্গ দোষে সাবেক ভাষাকে ঘৃণা করিয়া নয়া ভাষার আশ্রয় লইয়াছেন এবং তাঁহাদের শক্তি সাধারণতঃ কাব্য কবিতা ও উপন্যাস লিখনে ব্যয় হইয়াছে। তাঁহারা সময় সময় সমাজের বা ধর্ম্মের উপকারের জন্য যে সকল বহি লিখেন তাহার ভাষা সাধারণ লোকে সহজে বুঝেনা বলিয়া নিজ সমাজে সে সকল পুস্তকের আশানুরূপ আদর হয় নাই। হজরতের যে সব জীবনবৃত্তান্ত ছাপা হইয়াছে, তাহা প্রায়ই কবিতা বা উপন্যাসের সুরে দুর্ব্বোধ্য নূতন বাঙ্গালায় লিখিত। লেখকদের মধ্যে কেহ কেহ আল্লাহ স্থলে ঈশ্বর, রসুল স্থলে প্রেরিত পুরুষ, বিবি স্থলে দেবী, সাহেব স্থলে দেব, নামাজ রোজা স্থলে উপাসনা, উপবাস, মসজিদ স্থলে ভজনালয় ইত্যাদি ব্যবহার করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই।

হায়! আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ এতকাল যাবত আবশ্যক মতে আরবী ও পারসী হইতে শব্দাদি লইয়া বাঙ্গালা ভাষার যে অভাব পূরণ ও যে উন্নতি করিয়াছিলেন তাহা কি আমরা নাকাবেল কাপুরুষ সন্তানগণ গঙ্গায় ভাসাইয়া দিব?১ যে আরবী ভাষা ১০০০ হাজার বৎসর যাবত এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার ধর্ম্মনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অঙ্ক, চিকিৎসা গয়রহ সমগ্র শাস্ত্র শিক্ষা দিয়াছে, তাহা হইতে আমাদের পূর্ব্ব পুরুষ হিন্দু মুসলমানগণ মুসলমান আমলে ও ইংরেজ আমলের প্রারম্ভে যে সব আবশ্যকীয় শব্দ লইয়া নিজ বাঙ্গালা ভাষা গড়াইয়া ছিলেন, তাহা কি আমাদের ভুলিয়া যাওয়া কিম্বা উঠাইয়া দেওয়া উচিত! পূৰ্ব্ববর্ত্তী ভাষা ভুলিয়া নূতন ভাষা শিখিতে কি জাতীয় জীবনের বলক্ষয় হইবে না? এই অতিরিক্ত বলক্ষয়ের পর জীবন সংগ্রামে আমরা কি অপর জাতিদের সামনে দাঁড়াইতে পারিব? ভ্রাতৃগণ চিন্তা করুন, মুসলমানগণের এশিয়াবাসী হইয়া জাতীয় শব্দের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা ভাল দেখায় না। এখনও সময় আছে। সরকারী সেরেস্তার এখনো সাবেক ভাষা রহিয়াছে। লেখকগণের মুখে এখনও সাবেক কথাই প্ৰবল।

অনেকে বলেন যে নয়া বাঙ্গালাই প্রকৃত বাঙ্গালা এবং এই ভাষা সকলকে শিখাইতে হইবে। যদি ইহাতে আরও ১০০ বৎসর লাগে তবুও চেষ্টা করা উচিত, কারণ ইহাতে হিন্দু মুসলমানের ভাষা এক হইয়া যাইবে। এই কথাটী বলিতে বড় সুন্দর শুনায়, কিন্তু কাজে কতদূর সফল হইতে পারে, তাহাই ভাবিবার কথা। আমরা না হয় আরবী ফারসীর সংশ্রব ছাড়ান দিয়ে একশতাব্দী ব্যাপিয়া আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃগণের ও সংস্কৃতের সেবা করিলাম। কিন্তু এই সেবায় কি জাতীয় জীবনের অতিরিক্ত বলক্ষয় হইবে না? এবং এই সেবায় আমাদের যে সময় ও বলক্ষয় হইবে, আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃগণ এই সময়ের মধ্যে আমাদিগকে বহু পশ্চাতে ফেলিয়া যাইবেন না? তখন কি সংস্কৃত মন্ত্রে আমাদের জাতীয় জীবন প্রতিষ্ঠিত হইবে? লোকের অবস্থা, আচার, ব্যবহার, ধর্ম্ম ও নীতি অনুসারে ভাষাতে শব্দের সৃষ্টি হয় এবং অভাব বোধ হইলে অন্য ভাষা হইতে তাহা লওয়া হয়। ইংরেজগণ খৃষ্টান হওয়ার পর লাটীন ভাষা হইতে অনেক শব্দ লইয়াছেন। তাঁহারা বিজ্ঞান শিক্ষার পর আরবী ও গ্রীক ভাষা হইতে অনেক শব্দ লইয়াছেন। সেই সব শব্দ কি এখন তাঁহারা ফেলিয়া দিয়া নূতন শব্দ গঠনের চেষ্টা করিয়া নিজেদের বলক্ষয় করিতেছেন? তবে আমাদের কেন এই রোগ? মুসলমান হওয়ার পর আমাদের আচার ব্যবহার ও ধর্ম্ম কৰ্ম্ম সব নূতন হইয়া পড়িয়াছে, আমাদের ভাষা তদানুযায়ী গঠিত হইয়াছে। আমরা আবার পুনঃ হিন্দু হওয়া ভিন্ন কিছুতেই সেই গঠন ভাঙ্গিতে পারিব না ।

আমরা যদি জোর করিয়া অধর্ম্মবলে তাহা সম্প্রতি ভাঙ্গিয়া দি, কিছুকাল পরে তাহা আপনা আপনি আসিয়া পড়িত। ধৰ্ম্মপ্রাণ মুসলমানের পক্ষে অন্য শিক্ষার সহিত আরবী শিক্ষা নিতান্তই প্রয়োজনীয়। বর্তমান দুরবস্থার যতই দূর করার চেষ্টা হইবে, পুনঃ সুসময়েতে তাহা আসিয়া পড়িবে। তবে ফল কথা আমাদের পূর্ব্ববর্ত্তী ২০/২৫ পুরুষ যাহা করিয়াছেন, আমরা যদি তাহা ব্যর্থ করিতে থাকি, এবং আমরা যাহা করিব আমাদের পরবর্তীগণ তাহা বিফল করিবে। তোমাকে তাহা হইলে ইহার পরিণাম ফল কিরূপ শোচনীয় হইবে তাহা অবশ্য চিন্তার বিষয়। আমরা কেবল মাতৃভাষা নিয়া গোল করিতে থাকি, আর অপর জাতিগণ উন্নতির দিকে দৌড়িতে থাকুক। আজকালের সংসারে এক পদ পিছ পড়িলে তাহা সারিতে কত পুরুষ লাগে তাহা বলা যায় না। এ বিষয়ে আমাদের কি ভাবা উচিত নহে? হিন্দু ও মুসলমানের ভাষায় কতক ফরক অবশ্যই থাকিবে। হিন্দুর দৌড় সংস্কৃত, বেদ, রামায়ণের দিকে, আর মুসলমানের দৌড় আরবী ও কোরআনের দিকে থাকিবে। একজন দেব দেবীর নাম ও পূজার পদ্ধতি লিখিবে, আর একজন আল্লার তৌহিদ ও এবাদত তালীম করিবে। এইরূপ বিপরীত দিকে যাহাদের গতি তাহাদের সুরত, সীরত, ভাষা ও আচার ব্যবহারে কতক পার্থক্য নিশ্চয় হইবে ও থাকিবে, এইজন্য কাহারও উদ্বিগ্ন হইবার আবশ্যক নাই। কারণ ইহাতে নেক্‌২ ভিন্ন বদ্ কিছুই নাই, তবে কি আমরা একদেশের লোক আমাদের সাংসারিক স্বার্থপ্রায় জড়িত। আমরা একে অন্যকে সম্মান সমাদর করিব। একে অন্যের কথা ও ভাব বুঝিতে শিখিব, আবশ্যক মতে একে অন্যের সাহায্য এবং একত্র হইয়া কার্য্য করিব। কিন্তু এজন্য অসম্ভব সম্ভব হইবে না।

নিজ নিজ রীতিনীতি ধর্ম্ম ও ভাষা বজায় রাখিয়া সব করিব। আর এক কথা এই যে আমাদের মধ্যে বোধ করি এক লাখ লোকও নূতন শব্দ শিখে নাই। শিখিলেও সাবেক শব্দ সবগুলি বেশ মনে আছে। আমাদের লোকসংখ্যা প্রায় তিন শত লাখ হইবে। এই এক লাখের জন্য তিন শত লাখকে নূতন শব্দ সব শিখান যেরূপ মুস্কিল, কিন্তু এই এক লাখকে নিজও তিন শত লাখ লোকের ভাষা গ্রহণ করিয়া তাহা চাছাছিলা করতঃ তাহার উন্নতি করা এত মুস্কিল নহে। এবং ইহা দ্বারা অল্পকাল মধ্যেই জাতীয় দেহে নূতন জীবন দেওয়া হইতে পারে। কারণ এই ভাষায় বহি লেখা হউক, খবরের কাগজ লেখা হউক, সকলই লোকে বুঝিবে এবং তাহার দ্বারা ফল পাইবে। সমাজেরও উন্নতি হইবে। খবরের কাগজ ও বহি ইত্যাদি ফেল হইবে না। ঐ ভাষায় লিখিত হাজার হাজার পুথী৩ ও মসলা মসায়েলের কেতাব এখনও লোকের মধ্যে চলিত আছে এবং প্রত্যহ লেখা ও ছাপা হইতেছে। তবে কি সমাজের নেতা ও নব্য শিক্ষিত ব্যক্তিগণ মেহেরবাণী করিয়া এই ভাষা উদ্ধার ও সংস্কার করিলেই পুর্ব্বপুরুষদের কীর্ত্তি বজায় থাকে এবং সমাজের কল্যাণ হয়। এই ভাষাতে উর্দু ভাষা অপেক্ষা আরবী ফারসী শব্দ কম নহে। এই ভাষা জানে, সে কেবলমাত্র উর্দু ব্যকরণ শিখিলেই প্রায় সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়। তাহার আরবী, পারসী, তুর্কি শিখিবারও অতি সুবিধা, কারণ অনেক শব্দ পূর্ব্ব হইতে জানা থাকে। যেমন আকল শব্দ মাতৃভাষায় থাকিলে আরবী () শব্দ বুঝিতে কষ্ট হইবে না। যেমন () সোগল শব্দ (তুমি কি সোগলে আছ) মাতৃভাষায় থাকিলে আরবী পড়ার কালে () বুঝিতে কষ্ট হইবে না। তুর্কি, ফারসী এবং উর্দুতেও এই সব শব্দ থাকায় ঐ সব ভাষা বুঝিতে ও শিখিতে অনেক সুবিধা। হায়ৎ, এম, কেতাব, কলম ও লেবাস শব্দের সম্বন্ধেও এই যুক্তি খাটে। আমাদের আরবী, ফারসী ও তুর্কি বুঝিবার ও শিখিবার সুবিধা হইবে তেমনি আরব, ফারস দেশের লোকেরও আমাদের ভাষা শিখিবার ও বুঝিবার সুবিধা হইবে।

আমাদের হিন্দু ভ্রাতাগণকে এই বিষয়ে একটু চিন্তা করিতে অনুরোধ করি। ভাষার উদ্দেশ্য এই যে, মানব জাতি যেন একে অন্যের মনের ভাব বুঝিতে এবং প্রকাশ করিতে পারে। ভাষা যত অধিক লোকে বুঝে ততই তাহার ভাল। আমরা বাঙ্গালাতে বা ভারতে চিরকালের জন্য আবদ্ধ থাকিতে, বোধ করি কেহই চাহি না। ভারতের বাহিরে গেলে এখন আর জাতি যায় না। পূর্ব্বে লোকের নিকট ভারতই এক প্রকার পৃথিবী বলিয়া গণ্য হইত। আগে দিল্লি সহরের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তের খবর পাইতে যেরূপ সময়ও লাগিত এখন দিল্লি হইতে বোম্বাই, মাদ্রাজ, কলিকাতার খবর পাইতেও এত সময় ও কষ্ট লাগে না। পূর্ব্বে পাঞ্জাবে বাঙ্গালার বিষয় লোকের যেরূপ ধারণা ছিল এখন রেল, তার, প্রেস, আখবার ইত্যাদির সন্দকি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার সহিত অধিকতর ঘনিষ্ট হইয়াছে। আমাদের কি ইচ্ছা হয় না যে আমরা পৃথিবীর অপর দেশীয় ভাইদের সহিত মিশি, তাহাদিগকে আমাদের কিছু শিখাই কিংবা তাহাদের কিছু আমরা শিখি, এবং সকলে মিলিয়া মানবজাতির উন্নতি ও কল্যাণ সাধন করি? আমাদের বাঙ্গালা ভাষা এখনও ভালমতে গড়া হয় নাই, তাহার মাত্র গড়নের সামান সব হইতেছে। যখন ধৰ্ম্ম, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি মানবের যত বিষয় জানিবার আছে, সমস্ত এই ভাষাতে আসিয়া স্থান পাইবে, তখন ভাষার গঠন পূর্ণ হইয়াছে বুঝিতে হইবে। অতএব এই সময় আমাদের একটি চিন্তা করা উচিত। আমাদের বিবেচনা করা উচিত, কোন ভাষার শব্দ অক্ষর বা অঙ্ক গ্রহণ করিলে আমাদের অধিক সুবিধা হয়।

কোন ভাষা হইতে শব্দ লইলে আমাদের ভাষার উদ্দেশ্য অধিক সফল হয়।

বর্তমানের শব্দ সকল প্রায় সংস্কৃত হইতেই লওয়া এবং প্রস্তুত করা হইতেছে। পূর্ব্বের আরব্য শব্দ সকলকে দূর করিয়া দিয়া অনেক স্থলে নূতন গড়া শব্দ বসাইবার যোগাড় এবং চেষ্টা হইতেছে। এখন আমাদের দেখা উচিত যে, সংস্কৃত শব্দ লইলে আমাদের লাভ, না আরবী শব্দ লইলে। মুসলমানদের হয়ত আরবীর দিকে একটু ঝোঁক থাকিতে পারে। এই জন্য হিন্দু ভ্রাতৃগণকে একটু চিন্তা ও নিরপেক্ষতার সহিত বিবেচনা করিতে বলা হইতেছে। সংস্কৃত ভাষা একটী মৃত ভাষা, এই ভাষাতে কোন দেশের লোক এখন কথা বলে না, ভারতের ভাষা সকলের মধ্যে তাহার কতক শব্দ স্থান পাইতে পারে, কিন্তু ভারতের বাহিরে কোথাও তাহার বড় স্থান নাই। অতএব এই ভাষা হইতে শব্দাদি লইলে বুঝিতে হইবে যে, আমরা ভারতের বাহিরের লোকের ভাষা শিখিবার বা তাহাদিগকে আমাদের ভাষা শিখাইবার সুযোগ করিতেছি না বরং তাহার বিপরীত বাধা বিঘ্ন উৎপত্তি করিতেছি। আরবী ভাষা এশিয়া আফ্রিকার অধিকাংশ স্থানে লোকের মুখে বৰ্ত্তমান আছে, এবং বাকী সকল দেশেই অল্পাধিক এই ভাষা জানে, এমন লোক আছে। ভারতের মুসলমানগণ প্রায় সকলেই তাহার কিছু না কিছু পড়িয়া থাকে, এবং ভারতের প্রচলিত সকল ভাষাতেই তাহার অনেক শব্দ স্থান পাইয়াছে। ইউরোপে ও আমেরিকার প্রায় সকল ভাষাতেও অনেক আরবী শব্দ ও অঙ্কের ব্যবহার আছে। কারণ Dark Age-র সময় আরবগণ হইতেই ইউরোপের লোক বিজ্ঞান ইত্যাদি শিখিতেন। যদি এমন ভাষা হইতে আমরা দরকারী শব্দ গুলি লই, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমাদের ভাষা অধিকতর লোকে, ভারতে এবং ভারতের বাহিরে বুঝিবার বা শিখিবার সুযোগ পাইবে। এবং আমাদেরও অধিকতর লোকের ভাষা বুঝিবার ও শিখিবার সুবিধা হইবে।

দ্বিতীয়তঃ ইহাতে ভারতের হিন্দু মুসলমান ঘনিষ্টতা বাড়িবে এবং ভারতের বাহিরেও অপর এশিয়া আফ্রিকা বাসীদের সহিত কতক সম্বন্ধ ও প্রণয় বাড়িবে। এক ভাষা কিংবা তাহার কাছাকাছি হইলে মানবের সম্বন্ধ ও প্রণয় না বাড়িয়া পারেনা, এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুবিধাও আছে। যেমন আরজদাখিল আমাদের ভাষায় আছে। যথা আমার আরজ এই আমার আরজী খানা দাখিল করিয়াছি। যদি আমরা ভারতের উর্দু প্রভৃতি ভাষা পড়ি বা শুনি এই আরজ আরজীদাখিল শব্দ পাইলেই তাহাদের মানি বুঝিব। সেইরূপ আমরা ভারতের বাহিরে আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, পারস্য, আরব, তুর্কি, মিশর, যাবা, সুমাত্রা, গয়রহ দেশে গেলেও আমাদের এই সব শব্দ (আরজ আরজী দাখিল মানি গং) ঐ সব দেশের লোকে বুঝিবে, কারণ তাহাদের দেশীয় ভাষাতেও এই সব শব্দ স্থান পাইয়াছে। এবং তাহারা এই সব শব্দ মিশাইয়া কথা বলিলে তাহাও আমরা কতক বুঝিতে পারিব। এবং পরস্পর একে অন্যের ভাষা শিখিতেও অল্প সময় লাগিবে, এবং অনেক সুবিধা হইবে। এইরূপ আরও হাজার হাজার শব্দের বিষয় বলা যাইতে পারে। যেমন আল, কলম, দোয়াত, কেতাব, দোকান, ময়দান ইত্যাদি। আকল শব্দের স্থলে বিবেক, কলমের স্থলে লিখণী, দোয়াতের স্থলে মস্যাধার, আরজ স্থলে প্রার্থনা, ইত্যাদি আমরা অবলম্বন করিলে একেত নূতন শব্দের আবিষ্কার ও শিক্ষার মেহনত,

দ্বিতীয়তঃ পড়সী জাতিদের হইতে এক-ঘরে হওয়ার বন্দোবস্ত।৪ আরবী শব্দ বহাল রাখিলে এবং আবশ্যক মতে গ্রহণ করিলে কি সুবিধা হয় তাহা পরে পরিষ্কার মতে দেখাইতেছি।

টীকা

১. এইরূপ যুক্তি গ্রহণীয় হইলে, লাটিন, গ্রীক, আরবী হইতে যে সকল শব্দ ইংরেজীতে লওয়া হইয়াছে। তাহা ইংরেজদের ফেলিয়া দেওয়া উচিত Eolneatcon স্থলে Learning, Department স্থলে Branch বসিবে ইত্যাদি এবং এই করিতে করিতে আবার সেই জঙ্গলী Saken হইবে।

২. পাঠক যাহার মধ্যে এই পার্থক্য নাই তাহার আখেরত কার সঙ্গে হইবে? আলেমদিগকে জিজ্ঞাসা করিলে বলিবে নিশ্চয় মোমিনের সঙ্গে নহে।

৩. অবশ্য আমি পুথীর ভাষার বিশেষ পক্ষপাতী নহি। কারণ তাহাতে অনাবশ্যকীয় অনেক শক্ত আরবী ফারসী শব্দ আছে। যে সব শব্দ আমাদের ভাষাতে নাই, তাহা লওয়া উচিত নহে এবং যে সব শব্দ আমাদের ভাষাগত হইয়াছে তাহা রাখা উচিত, অতিমাত্রায় কোন বিষয় ভাল নহে। অনেক মুসলমান তাঁহাদের বহি হিন্দু পড়িবে মনে করিয়া কঠিন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিয়া বিদ্যার দৌড় দেখান, কিন্তু ফলতঃ ঐ সব বহি হিন্দুও পড়ে না এবং মুসলমানও পড়িতে পারে না। মুসলমান লেখকের সাধারণতঃ মনে করা উচিত যে, তাহার বহি মুসলমানই অধিক পড়িবে। অতএব ভাষা শুদ্ধ রাখিয়া যাহাতে অধিক মুসলমান বুঝিতে পারে, তাহাই করা উচিত। যে লেখা সহজ, শুদ্ধ এবং অধিক লোকে বুঝে তাহাই ভাল। লিখিবার উদ্দেশ্য বিদ্যা প্রকাশ করা নহে বরং ভাব প্রকাশ করা এবং প্রচার করা।

৪. সংস্কৃত ছাড়িয়া পারসী ভাষা হইতে শব্দ লইলেও কতক জাতিদের সহিত মিলা যায়, যদিচ আরবীর মত নহে।

(উৎস: আল্‌-এস্‌লাম, প্রথম ভাগ, সপ্তম সংখ্যা, কার্তিক ১৩২২, পৃষ্ঠা ৩৯৬-৪০২, অষ্টম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৩২২, পৃষ্ঠা ৪৬৪-৪৬৫। পত্রিকা পাঠে লেখকের নামে খাদেমোল্ এসলাম, বঙ্গবাসী উল্লেখ আছে)

[ওপরের রচনাটি রাজ্যেশ্বর সিন্হা সম্পাদিত আপন হতে বাহিরে: মুসলমান বাঙালি সম্পাদিত সাময়িকপত্রের ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক নির্বাচিত রচনা সংকলন ১৯০০-১৯৩০ (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা) গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত]

প্রথম প্রকাশ: বণিক বার্তা

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১০

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১১

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

১২

জনগণ আসলে কী চায়

১৩

শহীদ বুদ্ধিজীবী / সুধীর চন্দ্র মজুমদার

১৪

শহীদ বুদ্ধিজীবী / মহসিন আলী

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আবুল বাশার মহিউদ্দিন আহম্মদ

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / ফাদার লুকাশ মারান্ডি

১৭

বুরুঙ্গা গণহত্যা: ৯৪ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা

১৮

২৬ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল দিন

১৯

২৫ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী

২০