ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
একজন অমর মুক্তিযোদ্ধার জীবনী

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
২০ আগস্ট ২০২৫, ০৫:২৭ পিএম
২০ আগস্ট ২০২৫, ০৫:৫৯ পিএম
বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডে অবস্থিত তাঁর পৈত্রিক বাড়ি "মোবারক লজ"-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী আবদুস সামাদ ছিলেন একজন সরকারি চাকরিজীবী এবং মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। নয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মতিউর ছিলেন অষ্টম সন্তান। তাঁর শৈশব কেটেছে ঢাকার পুরানো এলাকায়, যেখানে তিনি সাধারণ কিন্তু রুচিসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে সকলের মধ্যে আলাদা হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুল, সারগোদায় ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে তিনি সেখান থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।

সামরিক জীবন ও প্রশিক্ষণ

১৯৬১ সালের ১৫ আগস্ট মতিউর রহমান পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমি, রিসালপুরে ৩৬তম জিডি (পি) কোর্সে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। একাডেমিক বিষয় এবং খেলাধুলায় তাঁর দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৩ সালের ২৩ জুন তিনি ফ্লাইট ব্রাঞ্চে কমিশন লাভ করেন এবং তাঁর সার্ভিস নম্বর ছিল পিএকে-৪৩৬৭। কমিশন প্রাপ্তির পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ার বেসের ২ নম্বর স্কোয়াড্রনে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিয়োজিত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের উপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ৭৫.৬৬% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি এফ-৮৬ স্যাবর জেটের উপরও কনভার্সন কোর্স করেন এবং ৮১% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তাঁর এই দক্ষতার কারণে তাঁকে পেশোয়ারের ১৯ নম্বর স্কোয়াড্রনে পোস্টিং দেওয়া হয়।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর সারগোদায় মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় তা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে তিনি অসীম দক্ষতার সাথে প্যারাসুট ব্যবহার করে নিরাপদে মাটিতে অবতরণ করেন। পেশোয়ারে ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। ১৯৭০ সালে তাঁকে জেট ফ্লাইং প্রশিক্ষক হিসেবে বদলি করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে আসেন। ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি ছিলেন নরসিংদীর রায়পুরার রামনগর গ্রামে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং ভৈরব বাজারে মিছিল নিয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে তিনি একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী তাঁদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করলে তিনি পূর্বেই ঘাঁটি পরিবর্তন করে ক্ষয়ক্ষতি এড়ান।

২৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ৯ মে সপরিবারে করাচিতে ফিরে যান। করাচিতে পৌঁছে তিনি লক্ষ্য করেন যে বাঙালি অফিসারদের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। তাঁকে ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা তাঁর পাইলট দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তিনি তখন একটি বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।

বিমান ছিনতাই ও শহাদত

১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট সকালে করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটিতে মতিউর রহমান তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে যান। তিনি তাঁর ছাত্র, ২১ বছর বয়সী পাকিস্তানি পাইলট অফিসার রাশেদ মিনহাজের টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিনতাই করার চেষ্টা করেন। মিনহাজ যখন বিমানটি রানওয়েতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, মতিউর তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ট্যাক্সি ট্র্যাকের দিকে যান এবং মিনহাজকে থামার সংকেত দেন। মিনহাজ ক্যানোপি খুলে জিজ্ঞাসা করলে, মতিউর দ্রুত ককপিটে উঠে তাঁকে ক্লোরোফর্মযুক্ত রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করার চেষ্টা করেন। তবে মিনহাজ জ্ঞান হারানোর আগে কন্ট্রোল টাওয়ারে বিপদবার্তা পাঠাতে সক্ষম হন।

বিমানটি ভারত সীমান্তের দিকে উড়তে শুরু করলেও মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে এবং দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। এর ফলে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে তালাহার নামক স্থানে বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমান প্যারাসুট ছাড়াই বিমান থেকে ছিটকে পড়েন এবং শহীদ হন। তাঁর মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে পাওয়া যায়। রাশেদ মিনহাজও এই দুর্ঘটনায় মারা যান।

সম্মান ও স্মরণ

মতিউর রহমানের এই অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করে। পাকিস্তান সরকার তাঁর মরদেহ করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে সমাহিত করে এবং তাঁর সমাধিতে “এখানে ঘুমিয়ে আছে এক বিশ্বাসঘাতক” লেখা হয়। তবে ২০০৬ সালের ২৪ জুন তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ২৫ জুন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পূর্ণ মর্যাদায় পুনরায় সমাহিত করা হয়।

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার রামনগরে (বর্তমানে মতিউরনগর) তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জাদুঘরে প্রায় ২৮০০টি বই রয়েছে, যদিও তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন সেখানে সংরক্ষিত নেই। এছাড়া, মুন্সীগঞ্জে তাঁর নামে একটি স্টেডিয়াম নামকরণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্টেডিয়াম নামে পরিচিত।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান তাঁর অসাধারণ সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অমর নাম হয়ে আছেন। তাঁর জীবন ও শহাদত বাঙালি জাতির জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি শুধু একজন পাইলটই ছিলেন না, বরং তাঁর দূরদর্শিতা, সাহস এবং মাতৃভূমির প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা তাঁকে একজন কিংবদন্তি বীরে পরিণত করেছে। তাঁর আত্মত্যাগ বাংলাদেশের প্রতিটি প্রজন্মের কাছে চিরকাল প্রেরণা জোগাবে।

তথ্যসূত্র:

উইকিপিডিয়া: মতিউর রহমান (বীরশ্রেষ্ঠ)

নরসিংদী জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট

রায়পুরা উপজেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট

দৈনিক প্রথম আলো

দৈনিক ইত্তেফাক

দ্য ডেইলি স্টার (বাংলা)

বাংলানিউজ২৪

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০