ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

পোমরা গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের এক অমানবিক অধ্যায়

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৩২ পিএম
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৫১ পিএম
ছবি: প্রতীকী

চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়ন—একটি শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ এলাকা, যা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষী। এখানকার পোমরা গণকবরটি সেই নির্মমতার প্রতীক, যেখানে ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হানাদাররা ১৩ জন নিরস্ত্র বাঙালি নাগরিককে জীবন্ত কবর দিয়েছিল। এই ঘটনা, যা 'পোমরা গণহত্যা' নামে পরিচিত। পোমরা সংরক্ষিত বনের পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই গণকবরস্থলটি আজও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অমর কাহিনির স্মৃতিচিহ্ন। এই প্রতিবেদনে ঘটনার পটভূমি, বিস্তারিত বর্ণনা, শহীদদের পরিচয় এবং পরবর্তী পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হবে, যাতে সেই দিনের ভয়াবহতা এবং মানবতার অপমানের সম্পূর্ণ ছবি উঠে আসে।

পটভূমি: মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযান এবং প্রতিশোধের ছায়া

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর আকার ধারণ করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা বাঙালিদের উপর নির্মম দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। পোমরা এলাকায় এই নির্যাতনের মূল কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সফল অভিযান। ১২ সেপ্টেম্বর (বা অনুসারে কিছু সূত্রে ১৩ সেপ্টেম্বর) পোমরা শান্তির হাটের উত্তরে প্রায় আধক্রোশ দূরে অবস্থিত মধুরাম তালুকদার পাড়ার স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি ৩৩ হাজার কেভি (কিলোভোল্ট অ্যাম্পিয়ার) ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করে দেন। এই অভিযানের ফলে সমগ্র রাঙ্গুনিয়া উপজেলা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী এতে ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যায়। দিনের বেলায় রাজাকাররা তাদের পথ দেখিয়ে দিলেও, রাতের অন্ধকারে অপারেশন চালানো তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘটনায় জড়িত হিসেবে তারা মধুরাম তালুকদার পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজাকাররা পাকিস্তানি হানাদারদের এই পাড়ার লোকজনদের সহযোগিতার কথা জানিয়ে দেয়, যা এই গণহত্যার মূল ট্রিগার হয়ে ওঠে। এই পটভূমি থেকেই বোঝা যায়, কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস পাকিস্তানি বাহিনীর হিংস্রতাকে আরও উস্কে দিয়েছিল।

ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা: অমানুষিক নির্যাতনের এক দিন

১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর—সেই ভয়াবহ দিনটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫০-৬০ জনের একটি হানাদার দল পোমরা শান্তির হাটের উত্তর দিকে অবস্থিত মধুরাম তালুকদার পাড়ায় হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই পাড়াটি মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসস্থান ছিল, যেখানে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, প্রৌঢ়-বৃদ্ধ সকলে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করত। কিন্তু সেই দিন পশুর দলটি তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তারা গ্রামবাসীদের ভয় দেখায়। একটি বিশেষভাবে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে: মাত্র ৭ দিনের এক কন্যা শিশুকে দোলনা থেকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে রাখা হয় এবং সেই দোলনার রশি খুলে নেয়া হয়। সেই রশিই ব্যবহার করে তারা একে একে ১৮ জন পুরুষকে বেঁধে ফেলে। এদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন বয়সের লোকজন, যারা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ধরা পড়ে।

তাদের চোখ গামছা এবং অন্যান্য কাপড় দিয়ে বেঁধে, গরু-পেটানোর মতো করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় পোমরা বনবিটের সামনে তাদের আস্তানায়। পথে শত শত নারী-পুরুষ পাকিস্তানি হানাদারদের পা জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করে, কিন্তু কোনো শেষ রক্ষা পান না। আস্তানায় পৌঁছে বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে ৫ জনকে অত্যন্ত পিটিয়ে আধমরা অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়। এই ৫ জনের নাম ছিল: অশ্বিনী দাশ, হরেকৃষ্ণ দাশ, মনমোহন দাশ, মনীন্দ্র দাশ এবং হরিকিষ্ট দাশ। তারা পরবর্তীকালে এই নির্মমতার সাক্ষ্য প্রদান করেন।

কিন্তু বাকি ১৩ জনের ভাগ্য ছিল আরও ভয়াবহ। তাদের পোমরা বনবিটের পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তারা নিজেরাই একটি বিরাট গর্ত খুঁড়তে বাধ্য হন। হাত-পা বেঁধে গর্তে ফেলার পর পাকিস্তানি হানাদাররা উল্লাস এবং অট্টহাসিতে মাটি চাপা দিয়ে জীবন্ত কবর দেয়। এই নির্মমতা ছিল এমনভাবে যে, শহীদরা গর্তে পড়ে চিৎকার করলেও কোনো রহম ছিল না। এই ১৩ শহীদের নাম নিম্নরূপ: মন্টু আইচ, গান্ধী দাশ, রমণী দাশ (বা রমনি দাশ), হরিপদ দাশ, জগৎ চন্দ্র দাশ, বাবুল চন্দ্র দাশ (বা বাবুল দাশ), বিরাজ দে, বোচা দে, ফকির চাঁদ, খোকা দাশ, দুলাল দাশ, শচীন দাশ এবং হরিকৃষ্ণ দাশ। এই শহীদরা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন এবং তাদের মৃত্যু বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পরিণতি এবং স্মৃতির সংরক্ষণ

পোমরা গণকবর সৃষ্টির কয়েক দিন পরেই এলাকাটি পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়। গ্রামবাসীরা গণকবরটি খুঁড়ে লাশ তুলে সৎকার করার চেষ্টা চালান, কিন্তু পচা দুর্গন্ধযুক্ত বীভৎস লাশগুলো তাদের পক্ষে স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। ফলে এই গণকবরটি অটুট রয়ে যায়, যা আজও সেই নির্মমতার সাক্ষ্য বহন করে। মুক্তিযুদ্ধের পর এই স্থানটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ছিল। ৪৫-৪৮ বছর পর্যন্ত এটি কেবল গোচারণভূমি বা মৌসুমী সবজির চাষের জমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা মহান শহীদদের প্রতি একটি বড় অপমান। স্থানীয়রা বারবার সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন, কিন্তু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে এটি অব্যবহৃত রয়েছে।

তবে, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর—মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবসের উপলক্ষে—দীর্ঘ ৪৮ বছর পর পোমরা বধ্যভূমিতে শহীদ স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এই স্তম্ভটি ১৩ শহীদের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এটি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় উদ্যোগের ফলস্বরূপ নির্মিত হয়েছে। তবুও, অনেক সূত্রে জানা যায় যে গণকবরের চারপাশে ঝোপঝাড় এবং অব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান, যা স্মৃতির সংরক্ষণে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির সহনশীলতা এবং প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

পোমরা গণকবরের ঘটনা শুধু একটি স্থানীয় হত্যাকাণ্ড নয়, বরং পাকিস্তানি দখলদারদের জাতিগত নির্যাতনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই ১৩ শহীদের বলিদান স্বাধীনতার পথে অমূল্য অবদান রেখেছে। আজ, ২০২৫ সালে এই ঘটনার ৫৪তম বার্ষিকীতে আমাদের কর্তব্য হলো এই স্মৃতিকে জাগরূক রাখা এবং শহীদদের সম্মান রক্ষা করা। স্থানীয় স্তরে সচেতনতা বাড়ানো এবং স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মাধ্যমে এই অধ্যায়কে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখা যায়।

সূত্র

মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত [৪২৩] এম. এ. কোরেশী শেলু।

উইকিপিডিয়া: পোমারা গণহত্যা।

সংগ্রামের নোটবুক: ১৯৭১.০৯.১৪ | পোমরা গণকবর | চট্টগ্রাম।

ডেইলি জনকণ্ঠ: রাঙ্গুনিয়ার পোমরা বধ্যভূমি এখন গোচারণ ভূমি।

প্রথম আলো: ১৩ জনকে জীবন্ত কবর দিয়ে উল্লাস করে হানাদারেরা।

একুশে পত্রিকা: রাঙ্গুনিয়ার ১৩ শহীদকে স্মরণ করেননি কেউ!।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাসনাবাদ গণহত্যা: লাকসামের অমানবিক অধ্যায়

পোমরা গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের এক অমানবিক অধ্যায়

১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর)

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ভুটানের রাজার শরণার্থীশিবির পরিদর্শন, অপ্রত্যাশিত সমর্থন

শোভনা গণহত্যা (খুলনা)

উদয়পুর গণহত্যা (মোল্লাহাট, বাগেরহাট)

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ

১০

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন

১১

ঘোড়াইল গণহত্যা (কেন্দুয়া, নেত্রকোনা)

১২

৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক চাপ এবং গেরিলা অভিযানের দিন

১৩

কাঁঠালতলা গণহত্যা (ফকিরহাট, বাগেরহাট)

১৪

সাভিয়ানগর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এক নৃশংস অধ্যায়

১৫

গোয়ালগ্রাম বধ্যভূমি: মুক্তিযুদ্ধের এক ভয়াবহ গণহত্যা (দৌলতপুর, কুষ্টিয়া)

১৬

গুরই গণহত্যা: একটি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি (নিকলী, কিশোরগঞ্জ)

১৭

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: কলকাতা মিশন হলো বাংলাদেশ হাইকমিশন

১৮

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ইকরদিয়া গণহত্যা – এক নির্মম অধ্যায়

১৯

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান, বিভিন্ন সেক্টরে আক্রমণ

২০