১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এই দিনে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক ঘটনা সংঘটিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করেছিল। নিম্নে এই দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো সুসংবদ্ধভাবে উপস্থাপন করা হলো।
আন্তর্জাতিক সম্মেলন, দিল্লি
২০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে তিন দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী দিন ছিল। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়াকে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলেন। তারা মনে করেন, এই স্বীকৃতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়ক হবে। প্রতিনিধিরা আরও উল্লেখ করেন, ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তবে অন্যান্য দেশের পক্ষে এটি সহজতর হবে। সম্মেলনের সমাপ্তিতে বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার মধ্যে ছিল:
মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম
এই দিনে মুজিবনগর থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে মুজিবনগর সরকারের আটজন সদস্য কলকাতা থেকে দিল্লি যাবেন এবং পরে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। এই প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে কলকাতায় পৌঁছেছিলেন। এছাড়া, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন থেকে সরাসরি নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ঢাকায় রাজনৈতিক ঘটনা
ঢাকায় এই দিনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটি দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় পরিষদ সদস্য সৈয়দ আজিজুল হকের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নূরুল আমিনের উপনির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার বিবৃতিকে সমর্থন করা হয়। একই দাবি জানান কাইয়ুম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খান এ সবুর।
এদিন পূর্ব পাকিস্তানের শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এ এস এম সোলায়মান এক বক্তব্যে দাবি করেন, “পাকিস্তানের বীর সেনাবাহিনী শত্রুকে নির্মূল করেছে। শত্রুরা পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিল, কিন্তু কোনো শক্তিই পাকিস্তান ভাঙতে পারবে না।”
ভারতে ঘটনাবলি
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লুধিয়ানায় এই দিনে এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “যেসব সরকার বা ব্যক্তি বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা ও পৈশাচিকতাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে, তারা পরোক্ষভাবে নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যাকে সমর্থন করছে।” তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্বাধীন স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী, তবে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক না হওয়ায় তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া সম্ভব নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শরণার্থীরা নিরাপদে ফিরতে পারবেন।
একই দিনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। তিনি সেখানে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের অবস্থান তুলে ধরবেন এবং রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করবেন।
আন্তর্জাতিক মহলে
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউল সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি শরণার্থী সমস্যা ও ভারতের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেন। উ থান্ট চলমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের উদ্বেগের কথা জানান।
একই দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা প্রাভদা-তে আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে দেওয়া বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তিনি শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে ফেরার জন্য পাকিস্তানের প্রতি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানান।
দেশব্যাপী ঘটনা
দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের ৭৮টি জাতীয় পরিষদ আসন এবং ১০৫টি প্রাদেশিক পরিষদ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়নপত্র গ্রহণের তারিখ ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর, বাছাই ১ ও ২ অক্টোবর এবং প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৮ অক্টোবর নির্ধারিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রংপুরের ডিমলা থানার সুটিবাড়ি হাটের কাছে জোড়জিগা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় ৯ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এছাড়া বালাপাড়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা মাইনে বিস্ফোরণে ৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পরে হানাদার বাহিনী বালাপাড়া গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
দাবানল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মালিকনগর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের গোলাগুলিতে ২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম: মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জগন্নাথদীঘির কাছে বাজানকারা সেতু ধ্বংস করে। সেতুর ধ্বংসের খবর পেয়ে ফেনী থেকে পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে এলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়, যাতে একজন অফিসারসহ ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
সিরাজগঞ্জ, শাহজাদপুর: ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী কায়েমপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালায়, যাতে বহু হানাদার সেনা হতাহত হয়।
লক্ষ্মীপুর, রামগঞ্জ: কমান্ডার সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী হানাদার ও রাজাকারদের রামগঞ্জ অবস্থানে হামলা চালায়। তুমুল যুদ্ধে ১৪ জন হানাদার সেনা নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: সোনা মসজিদের কাছে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী আর্টিলারি হামলা চালায়, যাতে অসংখ্য হানাদার সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ধোবড়া এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়।
রাজশাহী, চারঘাট: মুক্তিবাহিনী শান্তি কমিটির সেক্রেটারির বাড়িতে হামলা চালায়।
দিনাজপুর: ক্যাপ্টেন সুলতান শাহরিয়ার রশিদের নেতৃত্বে তিন কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদারদের অমরখানা অবস্থানে হামলা চালায়, যাতে ব্যাপক যুদ্ধ হয়।
ফেনী, ছাগলনাইয়া: কমান্ডার সুবেদার রহমান আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী চম্পকনগর বিওপি আক্রমণ করে, যাতে ৩ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
খুলনা, আশাশুনি: মুক্তিবাহিনী চাপড়ার রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। রাজাকারেরা পালিয়ে যায়, এবং মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের অস্ত্র ও রসদ দখলে নেয়।
সিলেট, কুমারশৈল: মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে একজন হানাদার সেনা নিহত হয়।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (তৃতীয়, পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)
দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মন্তব্য করুন