১৯৭১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামরিক এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, যা মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করেছিল। পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার পাশাপাশি এই দিনে বিভিন্ন ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা যোগ করে। নিম্নে এই দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো।
পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক একটি ১০ সদস্যের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেন। এই মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক শাসনের একটি প্রকাশ্য চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করে। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছিলেন:
এ এস এম সোলায়মান (ঢাকা)
অধ্যাপক শামসুল হক (চট্টগ্রাম)
অং শৈ প্রু চৌধুরী (পার্বত্য চট্টগ্রাম)
মওলানা এ কে এম ইউসুফ (খুলনা)
আখতার উদ্দিন খান (বরিশাল)
আবুল কাশেম (রংপুর)
আব্বাস আলী খান (বগুড়া)
মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক (পাবনা)
নওয়াজেশ আহমদ (কুষ্টিয়া)
ওবায়দুল্লাহ মজুমদার (নোয়াখালী)
এই মন্ত্রিসভা গঠনের ঘোষণা পাকিস্তানি শাসনের প্রতি স্থানীয় জনগণের সমর্থন বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হলেও, এটি মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতার মুখে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির বক্তব্য
একই দিনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিন ঢাকায় এক বক্তৃতায় বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠন করা হলেও আমরা এখনো বিপদমুক্ত হইনি। দুশমনের দল এখনো আমাদের চারপাশে চলাফেরা করছে। আমরা তাদের সমূলে উচ্ছেদ করব।” তার এই বক্তব্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কঠোর মনোভাব এবং যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ানোর ইঙ্গিত বহন করে।
অপারেশন ওমেগার স্বেচ্ছাসেবকদের মুক্তি
১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন অপারেশন ওমেগার স্বেচ্ছাসেবকদের কারাগার থেকে মুক্তি দেয় এবং তাদের ঢাকায় আনা হয়। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, “আমরা আশা করছি শিগগির তারা লন্ডনে ফিরে যেতে পারবেন।” এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের প্রতি কিছুটা চাপ সৃষ্টি করে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের বক্তব্য
একই দিনে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি রাজাকারদের উদ্দেশ্যে বলেন, “একমাত্র মুসলিম জাতীয়তায় পূর্ণ বিশ্বাসী ব্যক্তিরাই পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য জীবন দান করতে পারে এবং সত্যিকার মুসলমানরাই যে পাকিস্তানের প্রকৃত সম্পদ, এই সার্টিফিকেট পাকিস্তানের দুশমনরাই তাদের কার্যকলাপের দ্বারা এবার প্রদান করেছে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি শাসনের সমর্থনে রাজাকারদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করেন।
ভারতে ঘটনাবলি
ভারতের রাষ্ট্রপতির চিঠি
১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে একটি চিঠিতে বলেন, “ভারত যদি কোনো প্রকার আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে, তবে তা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে মত জোরালো করবে।” এই চিঠি ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনের প্রতিফলন ঘটায়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
একই দিনে কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর বলেন, “বাংলাদেশ এখন একটি চিরন্তন বাস্তবতা। এটি মেনেই পাকিস্তানকে যাবতীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।” এই বক্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতের দৃঢ় সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়।
ইন্দিরা গান্ধীর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তার বাসভবনে লোকসভার সদস্য প্রবোধ চন্দ্রের লেখা বাংলাদেশ রক্তস্নান বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। এই বই মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতা এবং বাঙালির সংগ্রামের গল্প তুলে ধরে, যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তানে ঘটনাবলি
১৭ সেপ্টেম্বর লাহোর থেকে প্রকাশিত ইমরোজ পত্রিকায় একটি সংবাদে বলা হয়, “একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক নিয়মিত শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। একই সঙ্গে তাকে নিয়মিত সংবাদপত্র পড়তে দেওয়া হচ্ছে।” এই সংবাদ শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবাসের সময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোকপাত করে।
আন্তর্জাতিক মহলে ঘটনাবলি
জাতিসংঘে ভারতের বক্তব্য
১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এক সভায় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউল বলেন, “বাংলাদেশে যে ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে যদি কেউ স্পষ্ট মন্তব্য না করে, তবে ভারত নিরপক্ষ দেশসমূহের মন্ত্রীদের সম্মেলনে যোগ দেবে না। ভারত চায় সুস্পষ্ট কোনো সমাধান।” এই বক্তব্য বাংলাদেশের মানবিক সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ফরাসি সাহিত্যিকের সমর্থন
একই দিনে প্যারিসে প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী অঁদ্রে মালরো এক বিবৃতিতে বলেন, “আমি বাংলাদেশে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। কারণ, তারা পূর্ব বাংলার অসহায় ও নিরীহ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। নিরীহ নারীদের ওপর বর্বরতা ও নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।” তার এই বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দেশব্যাপী ঘটনাবলি
ত্রাণ সামগ্রীর অপব্যবহার
১৭ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকায় “জল্লাদরা ত্রাণ সামগ্রী যুদ্ধের কাজে লাগাচ্ছে” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ইউনিসেফ এবং জাতিসংঘের অন্যান্য ত্রাণ সংস্থার যানবাহন ও সামগ্রী যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিসেফের একটি জিপে পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানকে দেখা গেছে। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রেরিত ত্রাণ সামগ্রী, যেমন রাবারের নৌকা ও দ্রুতগামী লঞ্চ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ সরকার লন্ডন মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘকে এ বিষয়ে অবহিত করে।
পাকিস্তানি সেনা কমান্ডারের সফর
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী ১৭ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা সফর করেন। পরে তিনি কিশোরগঞ্জের তারাইলে শান্তিবাহিনীর একটি সভায় শান্তিবাহিনীর সদস্য, রাজাকার ও আলবদরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সফর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় সহযোগীদের মনোবল বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নিম্নে এই দিনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হলো:
কুমিল্লার কসবা: কসবার মেহারী গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নেয়। তবে মুক্তিবাহিনী গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অতর্কিত হামলা চালায়, যার ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরে আর্টিলারি সহায়তায় পাকিস্তানিরা পাল্টা হামলা চালালেও মুক্তিবাহিনীর দ্বিগুণ প্রতিরোধে তারা পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে ২১ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং ৪৩ জন আহত হয়।
মানিকগঞ্জের শিবালয়: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা থেকে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে শিবালয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ঘাঁটিতে তুমুল আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী ত্রিমুখী প্রতিরোধ গড়ে তুলে পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এই যুদ্ধে ১১ জন পাকিস্তানি সৈন্য এবং ১০ জন রাজাকার নিহত হয়।
সাতক্ষীরার গোয়ালডাঙ্গা: আশাশুনি থানার গোয়ালডাঙ্গায় রাজাকার ও আধাসামরিক মিলিশিয়াদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন শহীদ হন, তবে মুক্তিবাহিনী ৭৫টি রাইফেল দখল করে। একইভাবে, খুলনার গোয়ালডাঙ্গায় অনুরূপ যুদ্ধে প্রায় অর্ধশতাধিক রাজাকার ও মিলিশিয়া হতাহত হয়।
রংপুরের বনতারা: মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর গুলি চালালে পাঁচজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা প্রতিরোধের মুখে ব্যাপক যুদ্ধ হয়, যাতে আরও আটজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
ফেনীতে সেতু ধ্বংস: মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল ফেনীর বাগদিয়া সেতু উড়িয়ে দেয়, ফলে ফেনী ও কুমিল্লার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টর: আট নম্বর সেক্টরের গোজাডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাপুর বিওপির একটি জিপের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং তিনজন আহত হয়।
কুমিল্লার সায়েদাবাদ: দুই নম্বর সেক্টরে ‘ডি’ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা সায়েদাবাদের কাছে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে দুটি জিপ ও একটি ট্রাক ধ্বংস করে।
মসলিয়া ঘাঁটি: আট নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি মসলিয়া ঘাঁটি আক্রমণ করে, যাতে সাতজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
মৌলভীবাজারের লুবাচরা: মুক্তিবাহিনীর একটি দুঃসাহসিক অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর ২০ জন সৈন্য নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়।
মহেন্দ্রনগর: মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে একজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
পরাগপুর: আট নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর পরাগপুর অবস্থানে তীব্র আক্রমণ চালায়, যাতে ছয়জন হানাদার নিহত হয়।
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বেসামরিক শাসনের ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সাহসী অপারেশন পাকিস্তানি বাহিনীকে কোণঠাসা করে দেয়। একই সঙ্গে ভারত ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতাকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করে।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড।
দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন