১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে রাজনৈতিক, সামরিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি ঘটেছিল, যা বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম এবং পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে তাদের অটল সংকল্পকে প্রতিফলিত করে। নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য থেকে শুরু করে তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা—এই দিনের ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান গতিকে তুলে ধরে। নিম্নে এই দিনের বিভিন্ন ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো।
রাজনৈতিক ঘটনাবলি
শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক বিচার
১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র ঘোষণা করেন যে, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তিনি আরও জানান, শিগগিরই শেখ মুজিবকে তার “কৃতকর্মের” জন্য সাজার মুখোমুখি হতে হবে। এই ঘোষণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্মম দমননীতির প্রতিফলন ঘটায়। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার এবং তার বিরুদ্ধে গোপন বিচার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভাঙার একটি প্রচেষ্টা হলেও, এটি তাদের সংগ্রামকে আরও জোরদার করেছিল।
তাজউদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক বক্তৃতা
এই দিনে মুজিবনগর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এটি ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের নবম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত। তিনি বলেন, “১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকেই মূলত বাংলাদেশে একনায়কত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। আইয়ুব খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের রাজপথে গর্জে ওঠা স্বৈরাচারী আইয়ুবের পক্ষে সহনীয় ছিল না। যেভাবে আইয়ুবের পতন ঘটেছিল, ইয়াহিয়ার পতনও ঠিক সেভাবেই হবে।” তাজউদ্দীনের এই বক্তব্য বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং অটল প্রত্যয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংযোগ স্থাপন করে জনগণের মধ্যে সংগ্রামের প্রেরণা জাগিয়েছিলেন।
ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক বৈঠক
একই দিনে তাজউদ্দীন আহমদ, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধরের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাকিস্তানে ঘটনাবলি
নূরুল আমিনের পশ্চিম পাকিস্তান সফর
১৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নূরুল আমিন সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের একজন প্রতিনিধিকে জানান, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পশ্চিম পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করব। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য আবেদন জানানো হবে। এছাড়া, দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় চর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ এবং শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর আরও সমন্বিত কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হবে।” এই বক্তব্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধ দমনের পরিকল্পনা এবং স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে তাদের সমন্বয়ের প্রচেষ্টাকে উন্মোচিত করে।
আন্তর্জাতিক মহলে ঘটনাবলি
কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
১৬ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ১৭তম কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ভারতের তামিলনাড়ু বিধানসভার স্পিকার কে এ মথিয়ানগন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে চলমান নৃশংসতা বন্ধে কমনওয়েলথ দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এটি কেবল মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং আঞ্চলিক শান্তির জন্যও হুমকি। এর প্রভাব এখন ভারতে চরমভাবে অনুভূত হচ্ছে।” এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব
একই দিনে ডেনমার্কে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে ডেনিশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরদার করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
দেশব্যাপী ঘটনাবলি
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম সফর
১৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজী চট্টগ্রাম সফর করেন এবং সেখান থেকে রাঙ্গামাটিতে যান। রাঙ্গামাটিতে তাকে অভ্যর্থনা জানান চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। এ সময় ত্রিদিব রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনী ও আদিবাসীদের কার্যক্রম নিয়াজীর কাছে তুলে ধরেন, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় সহযোগীদের সমন্বয়ের একটি উদাহরণ।
জামালপুরে আলবদরের কার্যক্রম
একই দিনে জামালপুরের ইসলামপুর থানার আলবদরের ইনচার্জ এবং জেলা শান্তি কমিটির প্রচার সম্পাদক মুহম্মদ আব্দুলবারী দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় একটি চিঠিতে লেখেন, “জামালপুরে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থী ছাত্ররা আলবদর বাহিনী গঠন করে জামালপুর, শেরপুর, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও নালিতাবাড়ি এলাকা থেকে দুষ্কৃতকারীদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।” এই চিঠি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আলবদর বাহিনীর নৃশংস কার্যক্রমের প্রমাণ বহন করে।
খুলনায় মুক্ত এলাকা স্থাপন
১৬ সেপ্টেম্বর খুলনা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কালান্তর’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “গত ১৫ দিনে খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার সাড়ে ৬৩ বর্গমাইল অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে মুক্ত এলাকা স্থাপন করেছে।” এটি মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং তাদের অঞ্চল দখলের সাফল্যের প্রমাণ।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৬ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করে। নিম্নে এই দিনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের বিবরণ দেওয়া হলো:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় যুদ্ধ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কায়েমপুর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২০১ জন সৈন্য নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৬ জন আহত হন। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটলে মুক্তিবাহিনী কায়েমপুর ঘাঁটি দখল করে নেয়।
যশোরের বেলেরডাঙ্গায় যুদ্ধ
যশোরের বোয়ালীয়ার বেলেরডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। কয়েকদিন ধরে টানা যুদ্ধের পর কোনো ফলাফল না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একপর্যায়ে পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসেন।
রাজশাহীতে মর্টার হামলা
রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধারা সারদা পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মর্টার হামলা চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩০ জন সৈন্য নিহত এবং ৫০ জন আহত হয়।
রাজশাহীতে কানপুরে হামলা
একই দিনে রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কানপুর অবস্থানে হামলা চালায়। এতে ২ জন হানাদার সৈন্য নিহত এবং ৭টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়।
খুলনার ভোমরায় আক্রমণ
খুলনার ভোমরায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানে তীব্র আক্রমণ চালায়। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ৪ জন সৈন্য নিহত হয়।
কুমিল্লার চামুবসতিতে প্রতিরোধ
কুমিল্লার চামুবসতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩ জন সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের ঘোষণা, তাজউদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক বক্তৃতা, আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা এবং দেশব্যাপী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য অটল সংকল্পকে প্রকাশ করে। এই ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত করতে এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিকে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সূত্র
- *বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র* (পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড)
- *দৈনিক পাকিস্তান*, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
- *দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা*, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
- *সাপ্তাহিক কালান্তর পত্রিকা*, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মন্তব্য করুন