১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই দিনে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের সংকট নিয়ে বিভিন্ন দেশের নেতা ও কূটনীতিকদের বক্তব্য ও কার্যক্রম সামনে আসে, যা শান্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে একটি ইতিবাচক দিকনির্দেশনা প্রদান করে। একই সঙ্গে, মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযান এবং ভারতের সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এই দিনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই প্রতিবেদনে সেইসব ঘটনাবলীকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো, যাতে মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রেক্ষাপট স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ সংকটের আশু সমাধানের দাবি
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি এই দিন মস্কোতে আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহের সম্মানে আয়োজিত একটি প্রমুখ ভোজসভায় বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে বাংলাদেশ সংকটের আশু সমাধানের উপর জোর দেন। পদগোর্নির মতে, এই সংকটের দীর্ঘায়িত হওয়া শুধুমাত্র এই অঞ্চলের মানবিক বিপর্যয় বাড়াবে, বরং এটি বিশ্বশান্তির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি সম্প্রতি স্বাক্ষরিত সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তিকে এশিয়া ও বিশ্বব্যাপী শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বর্ণনা করেন। এই চুক্তি, তাঁর মতে, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সংকটকালীন পরিস্থিতিতে। এই বক্তব্য সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করে, যা পরবর্তীকালে যুদ্ধের সময় জাতিসংঘে তাদের ভূমিকাকে প্রভাবিত করে।
যুক্তরাজ্যে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক চাপ
একই দিনে, যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল লেবার পার্টি বাংলাদেশ সংকট নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। রয়টার্সের সূত্র অনুসারে, তারা অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করার ঘোষণা দেয়। লেবার পার্টির নেতারা মনে করেন, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়, এবং এটি পাকিস্তানি শাসকদের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর একটি কার্যকর উপায়। এছাড়া, তারা ভারত উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে শান্তির জন্য বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করে জাতিসংঘে এই যুক্তি তোলার জন্য যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক হোমকে অনুরোধ জানায়। এই অনুরোধের মাধ্যমে লেবার পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করে, যা যুক্তরাজ্যের মতো প্রভাবশালী দেশের রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমে পাকিস্তানকে চাপে ফেলার লক্ষ্য বহন করে।
ফিনল্যান্ডে বাংলাদেশের দূতের কূটনৈতিক প্রচারণা
ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে সফররত বাংলাদেশের দূত, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, এই দিনটি কূটনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ করে তোলেন। তিনি দেশটির কয়েকজন সাংসদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন, যাতে সংগ্রামের মানবিক দিক, পাকিস্তানি দমন-পীড়নের বিবরণ এবং স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিনল্যান্ডের একজন প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীকে তাঁর সরকারের সমর্থন আদায়ের আশ্বাস দেন, যা বাংলাদেশের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বিবেচিত হয়। এরপর তিনি ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যিনি জানান যে ফিনল্যান্ড সরকার বাংলাদেশ আন্দোলনের ব্যাপকতা ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ। সন্ধ্যাকালে বিচারপতি চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত সংবাদপত্র *সুয়োম্যান সোসিয়ালি ডেমোক্রাত*-এর সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি এবং মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটিওসারিয়োর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকারে তারা বাংলাদেশ আন্দোলনকে যথাসম্ভব সাহায্য করার আশ্বাস দেন, যা মিডিয়া প্রচারণা, মানবাধিকার সমর্থন এবং কূটনৈতিক লবিংয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। এই কার্যক্রমগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়।
মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ
মুক্তিসংগ্রামের মানবিক দিক উন্মোচিত হয় যখন যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তাঞ্চলে পৌঁছান। তিনি মুজিবনগরে এসে ঘোষণা করেন যে, মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তারা কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবেন। এই উদ্যোগটি মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্য বহন করে, যা যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই সফর প্রবাসী বাঙালিদের সক্রিয় অংশগ্রহণের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ এবং চিকিৎসকদের সরবরাহের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে শক্তিশালী করে।
দিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা
দিল্লিতে সফররত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিনিধি মঈদুল হাসান এই দিন ভারতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎ করেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি. এন. ধর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যানসহ বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি. পি. ধরের সঙ্গে আলোচনা করেন। এই আলোচনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি, যেমন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমনমূলক কার্যকলাপ, শরণার্থী সংকট এবং মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই বৈঠকগুলো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা আরও গভীর করার পথ প্রশস্ত করে, যা পরবর্তীকালে যুদ্ধের সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলোতে সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণের সতর্কতা
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই দিন পশ্চিমবঙ্গসহ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোকে সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করে। রাজ্যের মুখ্য সচিব সাংবাদিকদের জানান যে, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানতে পেরেছে যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। বর্ষণ থেমে যাওয়ায় এই আক্রমণ যেকোনো সময় শুরু হতে পারে। এই হুমকির মোকাবিলায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এবং বিশেষ শাখা পুনর্গঠিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি, সামরিক অবস্থান এবং জনসাধারণের সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত। এই সতর্কতা ভারতের সামরিক প্রস্তুতির একটি স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে, যা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে।
পাকিস্তানের কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অবস্থা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই দিন ইরানের শাহের সঙ্গে পাকিস্তান সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য ইরান সফরে যান। তিনি ইরানের শাহকে পাকিস্তানের বর্তমান ঘটনাবলী, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সংঘাত এবং মুক্তিসংগ্রামের বিবরণ অবহিত করবেন। এই সফরটি পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যায়, যা ইরানের মতো মুসলিম দেশের কাছ থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা চাওয়ার লক্ষ্য বহন করে।
মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান: সেক্টরভিত্তিক সাফল্য
মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা এই দিন বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালিয়ে যান, যা যুদ্ধের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
১ নম্বর সেক্টর: এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মর্টার আক্রমণ চালান। পাল্টায় পাকিস্তানি বাহিনী কামান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে, যা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে। এই গোলাবর্ষণের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা অটল থেকে পাকিস্তানিদের ক্ষতিগ্রস্ত করেন। একই সেক্টরের আরেক দল কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করে, যাতে একটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই অভিযানে একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন, কিন্তু এটি মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
২ নম্বর সেক্টর: কয়েসপুরে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের ওপর রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে দুটি বাংকার ধ্বংস করা হয় এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল কসবা এলাকায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দুজন পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করে, যা শত্রু বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার একটি কার্যকর কৌশল ছিল।
৮ নম্বর সেক্টর: আলফাপুর এলাকায় একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন, যাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এই অভিযানগুলো মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় জ্ঞান এবং গেরিলা কৌশলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থায় ফেলে দেয়।
এই অভিযানগুলো মুক্তিসংগ্রামের তীব্রতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহসের প্রতীক, যা স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করে।
১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর এই ঘটনাবলী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করার প্রমাণ। আন্তর্জাতিক সমর্থন থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্রের সাহসী অভিযান—সবই মিলে স্বাধীনতার পথকে আরও নিশ্চিত করে। এই দিনটি ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে হিসেবে একটি টার্নিং পয়েন্ট, যা পরবর্তীকালে যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করে।
সূত্র
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও আট।
- মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, ইউপিএল, ঢাকা।
- স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
- আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
মন্তব্য করুন