ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

লালবাগের কেল্লা: বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন

প্রিয়ভূমি ডেস্ক
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫, ০৬:৩৫ পিএম
লালবাগের কেল্লা
লালবাগের কেল্লা

লালবাগ কেল্লা বা কেল্লা আওরঙ্গবাদ ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৭৮ সালে, মুঘল সুবেদার মুহাম্মদ আজম শাহ কর্তৃক, যিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র এবং পরবর্তীতে নিজেও সম্রাট পদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি দিল্লি চলে যান এতে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তার উত্তরসুরি, মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন, কিন্তু শেষ করেননি। কারণ মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ এর কন্যা পরিবীবী মারা যান। এ কারণে তিনি নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।

ইতিহাস

সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র, মুঘল রাজপুত্র আজম শাহ বাংলার সুবেদার থাকাকালীন ১৬৭৮ সালে এটার নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি বাংলায় ১৫ মাস ছিলেন। দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে পুনরায় বাংলার সুবেদার হিসেবে ঢাকায় এসে দুর্গের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন। ১৬৮৪ সালে এখানে শায়েস্তা খাঁর কন্যা ইরান দুখত রাহমাত বানুর (পরী বিবি) মৃত্যু ঘটে। কন্যার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খাঁ এ দুর্গটিকে অপয়া মনে করেন এবং ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে অসমাপ্ত অবস্থায় এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। লালবাগের কেল্লার তিনটি প্রধান স্থাপনার একটি হল পরী বিবির সমাধি। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগ করার পর এটি এর জনপ্রিয়তা হারায়। ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়েছিল; এটিই ছিল প্রধান কারণ। রাজকীয় মুঘল আমল সমাপ্ত হওয়ার পর দুর্গটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। ১৮৪৪ সালে এলাকাটি "আওরঙ্গবাদ" নাম বদলে "লালবাগ" নাম পায় এবং দুর্গটি পরিণত হয় লালবাগ দুর্গে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত এটি লালবাগ কেল্লা নামে পরিচিত।

অবকাঠামো

দীর্ঘ সময় যাবত এটি ধারণা করা হত যে, দুর্গটি হচ্ছে তিনটি ভবন স্থাপনার সমন্বয় (মসজিদ, পরী বিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই-আম), সাথে দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক উৎখননে অন্যান্য অবকাঠামোর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি বিরাট বুরূজ ছিল। দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের উত্তরে ছিল কয়েকটি ভবন, আস্তাবল, প্রশাসনিক ভবন, এবং পশ্চিম অংশে জলাধার ও ফোয়ারা সহ একটি সুন্দর ছাদ-বাগানের ব্যবস্থা ছিল।

আবাসিক অংশটি ছিল দুর্গ প্রাচীরের পশ্চিম-পূর্বে, প্রধানত মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিমে। দক্ষিণের দুর্গ প্রাচীরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে ৫ টি বুরুজ ছিল উচ্চতায় দুই তালার সমান, এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরে ছিল ২ টি বুরুজ যার সবচেয়ে বড়টি ছিল দক্ষিণস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারে।

বুরুজ গুলোর ছিল একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। কেল্লাটির কেন্দ্রীয় এলাকা দখল করে ছিল তিনটি প্রধান ভবন। পূর্বে দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম খানা, পশ্চিমে মসজিদটি এবং পরী বিবির সমাধি দুটোর মাঝখানে এক লাইনে, কিন্তু সমান দূরত্বে নয়। নির্দিষ্ট ব্যবধানে কয়েকটি ফোয়ারা সহ একটি পানির নালা তিনটি ভবনকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে।

দেওয়ান-ই-আম

দেওয়ান-ই-আম এবং এর সাথে সংযুক্ত হাম্মামের পেছনের অংশ । দেওয়ান-ই-আম বাংলার মুঘল গভর্নরদের দরবার ও বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

হাম্মাম খানা মূলত সুবেদারদের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহার হত । লালবাগ কেল্লার এই দালান কে দুটি কাজে ব্যবহার করা হতঃ হাম্মাম খানা (বাস ভবন হিসেবে), দেওয়ানে আম (বিচারালয় হিসেবে)। এই দালানের নিচ তালা ছিল বাস ভবন তথা হাম্মাম খানা আর উপরের তলা ছিল আদালত বা দেওয়ানে আম। শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বাস করতেন এবং এটাই ছিল তার আদালত। এখান থেকে তিনি সমস্ত বিচারকার্য পরিচালনা করতেন ।

পরীবিবির সমাধি

লালবাগ কেল্লার তিনটি স্থাপনার মধ্যে অন্যতম এটি। এখানে পরী বিবি সমাহিত আছেন। শায়েস্তা খান তার কন্যার স্মরণে এই মনমুগ্ধকর মাজারটি নির্মাণ করেন। লালবাগ কেল্লার তিনটি বিশাল দরজার মধ্যে বর্তমানে জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত । এই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়ে পরী বিবির সমাধি। আসলে "লালবাগ কেল্লা" বলতে যেই ছবিটি বেশি পরিচিত সেটি মূলত পরী বিবির সমাধির ছবি। পরী বিবি যার অন্য নাম ইরান দুখত রহমত বানু ছিলেন সুবাহ বাংলার মুঘল সুবেদারশায়েস্তা খানের কন্যা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সাথে ১৬৬৮ সালের ৩ মে পরী বিবির বিয়ে হয়। ১৬৮৪ সালে পরী বিবির অকালমৃত্যুর পর তাকে নির্মাণাধীন লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে সমাহিত করা হয়। তার সমাধীস্থলকে চিহ্নিত করে পরী বিবির মাজার নির্মিত হয়। পরী বিবির মাজারের স্থাপনাটি চতুষ্কোণ। মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছিল। মাঝের একটি ঘরে পরী বিবির সমাধিস্থল এবং এই ঘরটি ঘিরে আটটি ঘর আছে। স্থাপনাটির ছাদ করবেল পদ্ধতিতে কষ্টি পাথরে তৈরি এবং চারকোণে চারটি অষ্টকোণ মিনার ও মাঝে একটি অষ্টকোণ গম্বুজ আছে। মূল সমাধিসৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের এই গম্বুজটি একসময়ে স্বর্ণখচিত ছিল, পরবর্তীতে পিতলের/তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থাপনাটির অভ্যন্তর ভাগ সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে নির্মিত। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত বর্তমানে এখানে পরি বিবির মরদেহ নেই বলে।

শাহী মসজিদ

সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তিন গম্বুজওয়ালা দুর্গ মসজিদ এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। আয়তাকারে (১৯.১৯ মি: × ৯.৮৪ মি) নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি এদেশের প্রচলিত মুঘল মসজিদের একটি আদর্শ উদাহরণ। বর্তমানেও মসজিদটি মুসল্লিদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

পানির ট্যাংক

একটি বর্গাকৃতির পানির ট্যাংক (প্রতি পাশে ৪৫ মি) দেওয়ান-ই-আমের পূর্বদিকে স্থাপন করা হয়। সেখানে ট্যাংকে নামার জন্য চার কোণার সিঁড়ি আছে।

কেল্লা জাদুঘর

শায়েস্তা খাঁর বাসভবন ও দরবার হল বর্তমানে লালবাগ কেল্লা জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। জনপ্রতি ৩০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয়। বিদেশিদের জন্যে টিকিট মূল্য ১০০টাকা।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১০

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১১

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১২

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৩

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৪

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৫

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৬

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৭

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

১৮

৩০ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট

১৯

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা দেশ কখনোই সভ্য হতে পারে না

২০