১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মাটি রক্তে রঞ্জিত হয়েছে অসংখ্য গণহত্যার মাধ্যমে। এর মধ্যে ২০ মে ১৯৭১-এ সংঘটিত চুকনগর গণহত্যা ছিল এক ভয়াবহ নৃশংস ঘটনা, যেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় প্রায় ১২ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সর্ববৃহৎ একক গণহত্যাগুলোর মধ্যে একটি।
পটভূমি: কেন চুকনগর?
১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে (খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, ফরিদপুর) হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালায়। প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে।
চুকনগর বাজার ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ transit point। এটি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত, যেখান থেকে ভদ্রা নদী পেরিয়ে সাতক্ষীরা হয়ে ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছানো সহজ ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ পথে শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮-১৯ মে হঠাৎই চুকনগরে জড়ো হয় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ—অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যারা নৌকা, গরুর গাড়ি বা পায়ে হেঁটে এসেছিলেন।
গণহত্যার নীলনকশা
স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য গোলাম হোসেন (ইউপি চেয়ারম্যান) এবং বিহারী শামসুদ্দিন খাঁ পাকিস্তানি সেনাদের কাছে খবর দেয় যে, চুকনগরে হিন্দুদের বিশাল সমাগম হয়েছে। ২০ মে ভোরে, সাতক্ষীরা ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল (১ প্লাটুন) ট্রাক ও জিপে করে চুকনগরে পৌঁছায়।
কীভাবে ঘটল গণহত্যা?
সময়: সকাল ১১:৩০ থেকে বিকেল ৩:০০ (মাত্র ৪ ঘণ্টা)
হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতি
প্রথমে মালতিয়া গ্রামের চিকন আলী মোড়লকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এরপর পাতখোলা বিল, চুকনগর স্কুল, ভদ্রা নদীর পাড়সহ ৪ মাইল এলাকা জুড়ে লাইট মেশিনগান ও রাইফেল দিয়ে ব্রাশফায়ার চালানো হয়।
মানুষ দৌড়ালে তাদের নদীর দিকে তাড়া করে গুলি করা হয়। অনেকেই নদীতে ডুবে মারা যায়।
নারী-শিশুদেরও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।
নিহতের সংখ্যা: ১২ হাজারের বেশি
প্রত্যক্ষদর্শী আনসার আলী সরদার বলেন, “আমরা ৪২ জন মিলে ২১টি বাঁশের ভেলায় করে লাশ নদীতে ফেলেছি। প্রতি ভেলায় ২০০ করে লাশ।”
আফসার আলী সরকার (যিনি লাশ ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন) বলেন, “সেদিন আমরা কমপক্ষে ৫-৬ হাজার লাশ ফেলেছি।”
দেবাশীষ রায় (যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন) বলেন, “আমার চোখের সামনে বাবা, ভাই, কাকাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও গবেষণা
শর্মিলা বোস-এর মতো কিছু গবেষক এই গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু স্থানীয়দের সাক্ষ্য ও মুক্তিযুদ্ধের দলিলে এর ভয়াবহতা প্রমাণিত।
মুনতাসীর মামুন-এর গবেষণায় এই গণহত্যার বিস্তারিত উঠে এসেছে।
চুকনগর গণহত্যার স্মৃতি
প্রতি বছর ২০ মে ডুমুরিয়ায় শোক পালন করা হয়।
চুকনগরে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ।
বাংলাদেশ সরকার এই গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এটি এখনও তেমন আলোচিত নয়।
চুকনগর গণহত্যা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি ছিল মানবতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অপরাধ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কী মূল্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই গণহত্যার শিকার সকল শহীদকে গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই।
তথ্যসূত্র
১৯৭১: চুকনগরে গণহত্যা (মুনতাসীর মামুন)
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার (বাংলাদেশ গণহত্যা আর্কাইভ)
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাতীয় দলিল
মন্তব্য করুন