আমার দেখা তিনটি গণ-অভ্যুত্থানের পরিণতির মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি। প্রতিটির পরিণতি অভিন্ন। অথচ বহু ত্যাগ-আত্মত্যাগের অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি ঘটেছিল কেবলই ক্ষমতার হাতবদল। যে জনগণ আন্দোলনে সর্বাধিক অবদান রেখেছিল, সেই জনগণের কাছে ক্ষমতা পৌঁছায়নি। তাই গণ-অভ্যুত্থানে কেবলই শাসক বদল হয়েছে; সামষ্টিক সাফল্য আসেনি। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মামলাটি মিথ্যা ছিল না। মামলায় অভিযুক্ত প্রয়াত কর্নেল শওকত আলী তাঁর বইতে সেটা অকপটে স্বীকার করে লিখেছেন, ‘আগরতলা মামলা মিথ্যা ছিল না।’ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা ও কর্মকর্তাদের প্রতি অবাঙালি পাকিস্তানিদের চরম বৈষম্যপূর্ণ আচরণেই বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। লে. কমোডর মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে তাঁরা গোপনে অভ্যুত্থান সংঘটনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিষয়টি তাঁরা শেখ মুজিবকে পর্যন্ত অবগত করেছিলেন। তিনি তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ জন্য স্টুয়ার্ড মুজিবসহ কজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা আগরতলায় গিয়ে আলোচনা করে এসেছিলেন। দেশের সব সেনানিবাসের সামরিক বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সাক্ষাৎ করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ার মাঝেই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। ফলে একে একে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে মামলায় প্রধান অভিযুক্ত করা হয় শেখ মুজিবকে এবং দ্বিতীয় অভিযুক্ত করা হয় লে. কমোডর মোয়াজ্জেম হোসেনকে। এ ছাড়া সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অভিযুক্ত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সেনানিবাসের ভেতরে বিশেষ আদালতে চলে।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা চলাকালীন সাংবাদিক আতাউস সামাদের মাধ্যমে শেখ মুজিব তাঁদের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে মওলানা ভাসানীকে চিঠি পাঠান। চিঠিটি পাওয়ার পরক্ষণেই মওলানা ভাসানী আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের ছাত্র ও কৃষক সংগঠক আসাদ হত্যার মধ্য দিয়ে আন্দোলন দ্রুত দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। ২৪ জানুয়ারি কিশোর মতিউর হত্যার মধ্য দিয়ে আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
অবস্থা বেগতিক দেখে আইয়ুব খান মামলা প্রত্যাহার করে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। মওলানা ভাসানীর নির্দেশ উপেক্ষা করে শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করলেও বৈঠকের ফলাফল দাঁড়ায় শূন্য। সমঝোতার শত চেষ্টা করলেও আইয়ুব খানের প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহারের ফলেই আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। তাঁর স্থলে ক্ষমতায় আসেন অপর সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। অর্থাৎ, উনসত্তরের স্বাধিকার আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের পরিণতি ঘটে কেবল সামরিক শাসক বদলে। নতুন শাসক ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের মুলা ঝুলিয়ে দেওয়ার ফলে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা নির্বাচন ও ক্ষমতার মোহে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতার হস্তান্তর তো পরের কথা, নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করে তাদের পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছিল। অতঃপর এল পঁচিশে মার্চের গণহত্যা। অপ্রস্তুত ও অরক্ষিত জাতিকে নির্মূলের অভিযান। বাঙালি জাতিকে কিন্তু দমন ও নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। শুরুতে প্রতিরোধযুদ্ধ এবং মুজিবনগর সরকার গঠনের পর ভারতের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণ এবং ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের ত্যাগে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। উনসত্তরের অভ্যুত্থান-পরবর্তী আমাদের রাজনীতিকদের নির্বাচনের ফাঁদে ফেলে নির্মম গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। তবে আইয়ুববিরোধী দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামেই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। তাৎক্ষণিক ছিল না।
স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরিণতির পরম্পরা আমরা দেখেছি। এরশাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানেও যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল, সর্বদলীয় ঐকমত্যের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে জাতিকে রাজনৈতিক বিভক্তির অভিমুখে ঠেলে দেওয়া হয়। নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সরকার গঠন করলেও গণ-অভ্যুত্থানের যে তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল, ক্ষমতা পাওয়ার পর বিএনপি
সেই রূপরেখা বাস্তবায়ন না করে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে সামরিক শাসনের সংস্কৃতি ধারণ করে বসে। একইভাবে ওই সংস্কৃতির বৃত্তে আটকে পড়ে আওয়ামী লীগও। এরশাদের পতন বাস্তবে গণ-অভ্যুত্থানে সম্ভব ছিল না, যদি না সামরিক বাহিনী তাদের সমর্থন প্রত্যাহার না করত। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যেও সমষ্টিগত মানুষের আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুরিকাঘাত করতে দ্বিধা করেনি আমাদের শাসক দল দুটি।
জুলাই আন্দোলনখ্যাত গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়ই অভ্যুত্থান সফল হতে পেরেছে। অভ্যুত্থানের পরিণতি ঘটেছে কেবল শাসক বদলে। ব্যবস্থার বদল ঘটেনি। এই অভ্যুত্থানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিলেও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্বের আশপাশে ঘেঁষতে দেয়নি। তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল ষড়যন্ত্রে মোড়া অথচ আন্দোলনে সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করা সাধারণ আন্দোলনকারীদের মত ও পথের পার্থক্য দেখা গেছে আকাশ-পাতাল ব্যবধানতুল্য। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নামকরণে জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল বটে। তবে সেটা কেবলই কোটা বৈষম্যবিরোধী ছিল। সামাজিক বৈষম্যবিরোধী ছিল না। এমনকি তারা বলেওনি সামাজিক বৈষম্যের কথা। বরং তাদের অবস্থান ছিল জন-আকাঙ্ক্ষার ঠিক বিপরীত। ক্ষমতা বদলে যে সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় আসীন। আমাদের সংবিধানে এমন সরকার গঠনের কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারের প্রধান কাজটি হচ্ছে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। অথচ গত প্রায় ১০ মাসে তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। নির্বাহী বা রুটিন কাজের বাইরে এই সরকারের অপ্রত্যক্ষ মদদে রাজনৈতিক দল গঠনে আমরা হতবাক হয়েছি। হতবাক হয়েছি দেশের ভূমি-বন্দর বিদেশিদের কাছে তুলে দেওয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বিষয়েও। ইতিমধ্যে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূত এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কোন এখতিয়ারে তারা এখতিয়ারবহির্ভূত একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্রমেই অজনপ্রিয় সরকারে পরিণত হয়ে পড়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের মুখোশ ইতিমধ্যে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।
এটা তো স্বীকার করতেই হবে, সেনাবাহিনী যদি বিগত সরকারপ্রধানের নির্দেশ পালন করত, তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পরিণতি সফল হতে পারত না। সেনাবাহিনী সরকারের নির্দেশ অমান্য করার ফলেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সফল হতে পেরেছে। ঠিক উনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিক। তিনটি অভ্যুত্থান সফল হয়েছে কেবল জনগণের অভ্যুত্থানের ফলে নয়; সেনাবাহিনীর ভূমিকার কারণেই। তারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রাখার অভিপ্রায়েই জনগণের অভ্যুত্থানকে ক্ষমতার হাতবদলে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। সামাজিক বিপ্লব যাতে ঘটতে না পারে, সেই চেষ্টা যেমন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজ, এনজিও, রাষ্ট্রের দুই আমলাতন্ত্র—সবাই সামাজিক বিপ্লববিরোধী তো বটেই। তারা সংস্কারের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ বলেই তিন তিনটি গণ-অভ্যুত্থান প্রকৃতই সাফল্য লাভ করতে পারেনি। এটা যেমন দুঃখজনক, তেমনি হতাশাজনকও বটে।
উনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক পার্থক্য মোটা দাগে স্পষ্ট। ৫ আগস্টের পর দেশজুড়ে মব ভায়োলেন্সের মহোৎসব চলেছে। চলেছে বিগত সরকারের সংশ্লিষ্টতার অজুহাতে শিল্পকারখানায় আগুন দিয়ে, ভাঙচুর করে বন্ধ করে দেওয়া। এতে অগণিত শ্রমিক বেকারে পরিণত হয়েছেন। নিজ ছাত্রদের দ্বারা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও প্রতিষ্ঠান থেকে বলপূর্বক বের করে দেওয়ার মতো অজস্র ঘটনা ঘটেছে। দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছে দেশ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এমন ভয়াবহতা অতীতে দেখা যায়নি। তাই উনসত্তর ও নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট রূপে দৃশ্যমান।
মন্তব্য করুন