প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী সম্পূর্ণভাবে সৈন্য প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না। একমাত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়েই দুই পক্ষের আলোচনা হতে পারে।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স-কে লেখা চিঠিতে সতর্ক করে বলেন, “পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩৫ লাখের বেশি শরণার্থী পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।” তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা জানান।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী মার্কিন সিনেটরদের কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান-এর সাক্ষাৎকারের বিবরণ পেশ করেন, যেখানে ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
ভারতের ভূমিকা
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং দিল্লিতে বলেন, “পাকিস্তান পূর্ব বাংলার গণহত্যা ও শরণার্থী সংকটকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে আখ্যায়িত করছে, যা অমানবিক।”
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনপ্রধান হোসেন আলী-কে ১ লাখ টাকা দান করেন মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তায়।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
জুলফিকার আলী ভুট্টো (পিপিপি চেয়ারম্যান) দাবি করেন, “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় পিপলস পার্টিই এখন পাকিস্তানের বৃহত্তম দল। পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব আমাদের উপর।” তিনি ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা করে বলেন, “ভারত পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে।”
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা
বরগুনা জেলখানায় গণহত্যা: পটুয়াখালীর সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা ৫৫ জন বাঙালি বন্দীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরদিন আরও ১৭ জনকে গুলি করে মারা হয়।
শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের নামে প্রপাগান্ডা: গভর্নর টিক্কা খান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন, যার চেয়ারম্যান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন।
মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ
কুমিল্লা: মুক্তিযোদ্ধারা রঘুরামপুর, শালদা নদীর পশ্চিম তীর (শিবপুর, বাজরা, সাগরতলী) এবং লাকসাম রেলস্টেশন-এ হামলা চালায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর দুররানি নিহত ও বহু সেনা হতাহত হয়।
চট্টগ্রাম: একটি পেট্রল পাম্প ধ্বংস করা হয়।
উত্তরবঙ্গ: নওগাঁর হরতকীডাঙ্গা ও পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীর সেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা হয়।
শান্তি কমিটি গঠন
পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী হিসেবে নোয়াখালী, চাঁদপুর, হাজীগঞ্জ, কচুয়া ও মতলবে শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
২৯ মে, ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযান ও বরগুনার গণহত্যা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা—সব মিলিয়ে এই দিনটি স্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (ষষ্ঠ, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ খণ্ড)
দৈনিক পাকিস্তান, ৩০ মে ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০-৩১ মে ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ১, ২, ৩, ৭)
মন্তব্য করুন