ঢাকা সোমবার, ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
২৭ মে ২০২৫, ০২:২৯ পিএম
৩১ মে ২০২৫, ০৯:১৩ পিএম
সদর উপজেলার হরিণা বাগবাটি গ্রামে গণহত্যার পর এই কুয়াতে লাশ ফেলা হয়েছিল | ছবি: বিডিনিউজ২৪
সদর উপজেলার হরিণা বাগবাটি গ্রামে গণহত্যার পর এই কুয়াতে লাশ ফেলা হয়েছিল | ছবি: বিডিনিউজ২৪

১৯৭১ সালের ২৭ মে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সিরাজগঞ্জের বাগবাটি ইউনিয়নে এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। এই হত্যাকাণ্ডে ২০০-এর বেশি নিরস্ত্র বাঙালি (প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের) নিহত হন। আল-বদর, রাজাকার ও স্থানীয় শান্তি কমিটির সহযোগিতায় সংঘটিত এই গণহত্যার পর লাশগুলো গণকবর দেওয়া হয় অথবা কূপে ফেলে দেওয়া হয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পৈশাচিক ঘটনাগুলোর একটি।

ঐতিহাসিক পটভূমি

অবস্থান: বাগবাটি ইউনিয়ন সিরাজগঞ্জ সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত (বর্তমানে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তর্গত)।

শরণার্থীদের আগমন: অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর সিরাজগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে শতাধিক বাঙালি হিন্দু পরিবার বাগবাটি, হরিণগোপাল, পিপুলবেরিয়া ও ধলদব গ্রামে আশ্রয় নেয়।

হত্যার পূর্বপ্রস্তুতি: গণহত্যার আগের দিন (২৬ মে) রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ঘোড়াছাড়া স্কুলে একটি গোপন সভা করে। সেখানে ৫০০+ বাঙালিকে "নির্মূল" করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

গণহত্যার বিবরণ

২৭ মে ভোররাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আল-বদর, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা যৌথভাবে বাগবাটি, হরিণগোপাল ও অলোকদিয়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। তাদের নৃশংসতায় ঘটনাক্রম-

গণহারে গুলিবর্ষণ: আল-বদর বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২০০+ মানুষকে হত্যা করে। বেশিরভাগই ছিলেন নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।

অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট: ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, সম্পদ লুট করা হয়।

নারী নির্যাতন: পাকিস্তানি সেনারা বহু নারীকে ধর্ষণ করে।

লাশের অপসারণ: পরের দিন বেঁচে থাকারা জমিদার বাড়ির কূপে ও অন্যান্য স্থানে মৃতদেহ ফেলে দেয়।

চোখে দেখা সাক্ষ্য

স্থানীয় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের মতে-

"ওরা আমাদের পুরুষদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। শিশুদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে।"

"মেয়েদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল… কান্নার শব্দে আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল।"

গণহত্যার পরবর্তী অবস্থা

গণকবর: ধলদব ও বাগবাটির জমিদার বাড়ির কূপগুলো লাশে ভরে যায়।

স্থানীয়দের ভূমিকা: অনেক মুসলিম প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারগুলোকে লুকিয়ে রেখে জীবন বাঁচায়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: তখনকার সময়ে এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তেমন প্রকাশ না পেলেও স্থানীয়ভাবে এটি একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।

স্মৃতিরক্ষা ও বর্তমান অবস্থা

স্মৃতিসৌধ: বাগবাটি ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয়দের উদ্যোগে একটি ছোট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে, যেখানে প্রতি বছর ২৭ মে শোক পালন করা হয়।

অবহেলিত গণকবর: স্থানীয়রা দাবি করে আসছে যে হত্যাকাণ্ডের স্থান ও গণকবরগুলো প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত করে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হোক।

লোকস্মৃতি: এলাকার প্রবীণরা এখনও সেই ভয়াবহ দিনের কথা স্মরণ করেন।

বাগবাটি গণহত্যা ১৯৭১-এর একটি নির্মম অধ্যায়, যা পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের নৃশংসতার চিহ্ন বহন করে। এই ঘটনাকে সঠিকভাবে ডকুমেন্টেশন ও স্মরণ করা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে কী মূল্যে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

“ওই কূপগুলো আজও যেন চিৎকার করে… আমরা ভুলিনি, ভুলবও না।” — স্থানীয় একজন বয়োজ্যেষ্ঠের উক্তি।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন

ধর্মান্ধতার শিকার প্রান্তিক নারীজীবনের কথাশিল্পী বানু মুশতাক

আইএমএফের পরামর্শ / ডলারের দাম বাজারীকরণের বিপদ

সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা

ভ্রমণপ্রেমী গভর্নরের নয় মাসে ৬৫ দিন বিদেশ সফর

বাজেটে স্বস্তি নেই মধ্যবিত্তের

কোদালিয়া গণহত্যা / নগরকান্দার রক্তঝরা ইতিহাস

১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

১০

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

১১

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

১২

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

১৩

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

১৪

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

১৫

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

১৬

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

১৭

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১৮

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১৯

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

২০