অনেকবারই তার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। ‘হার্ট ল্যাম্প’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চমকপ্রদ ছোটগল্পগুলোর তীক্ষ্ণ ভাষা, চরিত্রগুলোর সূক্ষ্মতা, নারীজীবনের বিশ্বস্ত ভাষ্যকার হিসেবে বানু মুশতাক অনুবাদক দীপা ভাস্তির সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলেন কথাশিল্প বা আখ্যান সৃজনের শীর্ষ আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার (২০২৫)।
‘হার্ট ল্যাম্প’, মুসলিম ও দলিত নারীদের ওপর লেখা ১২টি ছোটগল্পের সংকলন। এ গল্পগুলো লেখা হয় ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে। মূল বইটি বানু লিখেছেন সাড়ে ৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কন্নড় ভাষায়। ‘আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা প্রায়ই আমার বাবাকে বলত, এই মেয়ের জন্যই তোমার নাক কাটা যাবে। এখন আমি দেখছি, যদিও তিনি বেঁচে নেই, তার জন্যই গৌরব বয়ে এনেছি।’ বুকারের জন্য মনোনয়ন পাওয়ার পর কথাগুলো বলেছিলেন ৭৬ বছর বয়সী বানু মুশতাক।
বানু আজীবন ধর্মান্ধতা, পুরুষতন্ত্র, বর্ণাশ্রম প্রথা, সাম্প্রদায়িকতা, দলিত শ্রেণির অধিকার, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ন্যায্য প্রতিরোধ গড়ে তুলে লড়াই করে যাচ্ছেন। ধর্মের বিরুদ্ধে তার প্রথম প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল কন্নড় ভাষা দিয়ে। এ ভাষাটি তিনি শিখেছিলেন উদার বাবার সস্নেহ প্রশ্রয়ে। গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুসলমান মেয়েরা কেবল উর্দুতেই শিক্ষালাভ করে আর কোরআন পড়ে। তিনিও প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন একটা উর্দু স্কুলে। কিন্তু সেই স্কুলের কর্তৃত্ববাদী শিক্ষা বানুর ভালো লাগেনি। উদার অসাম্প্রদায়িক বাবা এরপর তাকে খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দিলে সেই স্কুলের শিক্ষাই তার জীবনের গতিপথ নির্মাণ করে দেয়। কন্নড় ভাষা, যাকে মনে করা হয় হিন্দুদের ভাষা, একজন মুসলমান মেয়ে শিখবে, স্কুলে ভর্তি হতে গেলে শিক্ষকরা সেটা বিশ্বাস করেননি। শর্ত দেওয়া হয়েছিল ছয় মাসের মধ্যে কন্নড় বর্ণমালা শিখতে হবে, না হলে স্কুলে ঠাঁই হবে না। বানু সেই বর্ণমালা আয়ত্ত করেছিলেন মাত্র এক মাসে। তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে, প্রথম শ্রেণি থেকে এক লাফে তাকে তুলে দেওয়া হয় চতুর্থ শ্রেণিতে। নিজেকে প্রকাশ করার আবেগে বর্ণমালা শেখার মুহূর্তেই শুরু করেন লেখালেখি।
লেখক হিসেবে দ্রোহী তিনি। দক্ষিণ ভারতের গ্রামীণ মুসলমান সম্প্রদায়ের এমন সব গল্প তিনি বলেছেন তার হার্ট ল্যাম্পে, যার অর্থ শুধু মুসলমান সমাজ সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকলেই বোঝা সম্ভব। বুকারের পশ্চিমী বিচারকদের কাছে নিঃসন্দেহে গল্পগুলো অভিনব মনে হয়েছে, যার জন্য তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। তবে শুধু পশ্চিমী নয়; বহুধারায়, বহু ধর্মে, বহু সংস্কৃতিতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজের পাঠকদের কাছেও তা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের সূত্রে সমাদৃত হয়েছে। মুসলমান সমাজের গড়নটা যে ভিন্ন, তা যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে বিশিষ্ট; বানুর গল্পে তারই চমকপ্রদ প্রতিফলন ঘটেছে।
দক্ষিণী সেই মুসলিম সমাজে বেশির ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় কৈশোরে। কিন্তু বানু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পেরেছেন। বয়স যখন ২৬ বছর, যে যুবকের প্রেমে পড়েন, তাকেই বিয়ে করে সংসারী হন। কিন্তু শুধু সংসার করার জন্য তার জন্ম হয়নি। ছোট থাকতেই গোগ্রাসে বই পড়া এবং লেখালেখি ছিল তার প্যাশন। ফলে বিবাহিত জীবনে যখন আবদ্ধ হয়ে পড়লেন তখন আবার লেখালেখি করবেন বলে স্থানীয় একটি সংবাদপত্রের আমন্ত্রণে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পত্রিকাটি ছিল একটি প্রতিবাদী প্রগতিশীল পত্রিকা। কর্নাটকের সাহিত্য মহলে তিনি প্রতিবাদী লেখক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। কিছুদিন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার পর তার মনে হলো আইনজীবী হিসেবে নিপীড়িতদের সাহায্য করবেন আর সেটাই হবে তার জীবিকা। জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় রাজনীতিতে। নিপীড়িতদের সংকট, আর্তনাদ ও কণ্ঠস্বরই হয়ে উঠল তার লেখার বিষয়-আশয়। প্রতিচ্ছবি আর প্রতিরোধের বয়ান। এই প্রতিরোধও শুরু করেছিলেন নিজের সংসারের ভেতর থেকে।
স্নাতক শেষ করার পর মুশতাক যখন শিক্ষকতা, আত্ম-আবিষ্কার ও লেখালেখির প্রস্তুতি নেবেন বলে ঠিক করেছেন, তখনই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় তিনি ভেঙে পড়েন। একান্নবর্তী পরিবারে স্বামী-শ্বশুরকুলের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে থাকেন, নিজের কোনো স্বাধীনতা নেই। স্বামী কাজ করেন শ্বশুরের ঘড়ির দোকানে। ‘আমি সবসময় লেখালেখি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লেখার মতো কিছুই ছিল না। হঠাৎ করে প্রেম-বিয়ে, আমাকে বলা হলো বোরখা পরতে এবং গৃহস্থালির কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে। আমার বয়স তখন ২৯, মা হয়েছি, প্রসবোত্তর বিষণ্ণতায় ভুগছি।’
বিয়ে, মাতৃত্ব আর ঘর-গেরস্থালী যখন তার সত্তাকে পীড়িত করছে, তখন হঠাৎ একদিন সমাধানের অভিনব একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ‘কঠিন জীবন, সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মহত্যা করব। ঘরে ঢুকলাম। গায়ে পেট্রোল ঢাললাম। ঠিক যখন ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরাব, স্বামী আমার হাত চেপে ধরল।’ কেন এমন করছি, জিজ্ঞেস করতেই বললাম, ‘আমি বিষণ্নতায় ভুগছি। আমি লিখতে চাই, লেখার জন্য স্বাধীনতা চাই। আমি বাইরে যাব। মানুষের সঙ্গে মিশব। লাইব্রেরিতে যাব পড়তে। যদি তুমি বাধা দাও আমি তোমাকে ডিভোর্স দেব। স্বামী আমার কথা মেনে নিলেন।’ কিন্তু বানুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাড়ির বউয়ের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। ছেলে আর ছেলের বউকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। এ ঘটনাই পরবর্তী সময়ে বানু মুশতাকের জন্য শাপে বর হয়েছে। তিনি প্রথমে শেলাই, পরে আইন পড়ে আইনজীবীর পেশা বেছে নেন।
ওপরে বানুর জীবনের যে গল্পটা বলেছি, হার্ট ল্যাম্পের একটা গল্প লেখা হয়েছে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বানু ঘটনাটি আরও কাব্যিকভাবে শেষ করেছেন মেহেরুন নামের চরিত্রের মধ্যদিয়ে। মেহেরুন যখন কেরোসিনে গা ভিজিয়ে ম্যাচ জ্বালাতে যাবে, তখনই ঘরের মেঝেয় শুয়ে থাকা কিশোরী কন্যা মাকে বাধা দেয়। ‘মেহেরুন ছোট মেয়ে সালমাকে মেঝে থেকে তুলে বুকের কাছে টেনে নিল; যেন কোনো বন্ধু তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, স্পর্শ করছে আর তার মনটা বুঝতে পারছে। সে শুধু বলতে পারল, আমাকে ক্ষমা করে দে মা, সোনা আমার।’
সেই থেকে মুশতাকের জীবন সংগ্রামের শুরু। তার গল্পের চরিত্রগুলো তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। বানুর গল্পগুলোতে পাঠক প্রায়শই এমন নারীদের দেখা পেয়ে যান, যাদের দরিদ্র স্বামীরা এক বউ থাকতে সংসারে নতুন আরেক বউ নিয়ে আসে। অনেক নারীর অস্তিত্ব উত্তরাধিকারী হিসেবে পুত্রসন্তান জন্ম দিতে না পারায় ছয়-সাত কন্যাসন্তান জন্মদানের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। পুরুষরাও তাদের স্ত্রী ও মায়েদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে পিতৃতন্ত্রের শ্বাসরোধ থেকে রেহাই পান না। ‘পুরুষের তুলনায় নারীরা প্রায়শই নারীদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করে। তারা পুরুষদের জুতা পায়ে পরে আর নিজস্ব কৌশলে নারীদের ওপরই নির্যাতন চালায়।’
রুশ ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তইয়েফ্স্কি এবং কন্নড় লেখক দেবানুর মহাদেবের দ্বারা অনুপ্রাণিত বানু এভাবেই গল্প বলতে পছন্দ করেন। তিনি তার নিজের মুসলমান সম্প্রদায়ের কঠোর সমালোচক। মুশতাক জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, যারা তাকে দমন করতে চায়, ‘আমার চারপাশের মুসলিম সম্প্রদায় আমাকে বহিষ্কার করতে চায়। তারা মনে করে আমি তাদের সমালোচনা করে প্রশংসা কুড়াচ্ছি।’ একবার তো এক লোক তার অফিসে এসে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করেছিল। বানুর স্বামী তাকে নিরস্ত্র করে।
বিদ্রূপ, শুষ্ক রসবোধ, সহমর্মিতা, বানুর লেখার সবচেয়ে প্রিয় বৈশিষ্ট্য। অনুবাদক দীপা ভাস্তি বলেছেন, ‘সমাজ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতি তার সমালোচনা খুবই সূক্ষ্ম। তার লেখার এ গুণটির আমি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করব।’
ভারতীয় মূলধারার সাহিত্যে মুসলমান নারীদের প্রায়শই রূপক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তারা সবসময়ই নীরব ভুক্তভোগী। কিন্তু মুশতাক এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তার চরিত্ররা সহ্য করে, সমালোচনা করে এবং জীর্ণ সমাজের ছবি তুলে আনে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে অসম ক্ষমতার কাঠামো কীভাবে কাজ করে অন্তর্দর্শী দৃষ্টি দিয়ে সেটা পাঠককে দেখিয়ে দেন বানু মুশতাক।
মন্তব্য করুন