প্রাচীন ভারতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অঞ্চল শাসিত হতো। তখন পৃথিবীতে মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রবর্তন হয়নি। এই রাজ্যটি ছিল যৌধেয় জাতির শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল। এটি ছিল মূলত সিন্ধু নদ এবং এর উপনদীগুলোর আশপাশের সমতল ভূমি। এই অঞ্চলে ওই সময় যৌধেয় জাতিরা বসবাস করত। যৌধেয়রা উপমহাদেশের একটি প্রাচীন জাতি। অনেক ইতিহাসবিদ যৌধেয়দের আদিবাসী হিসেবে আখ্যা দেন, তবে এই আখ্যা দেওয়া ভুল; এরা মূলত ওই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী। যৌধেয় জাতি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসবাস করত। তারা ছিল মূলত যোদ্ধা জাতি। যৌধেয়রা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য গণতান্ত্রিকভাবে রাজা (যাকে তারা পুরস্কর্তা বলত, যার অর্থ সভাপতি) নির্বাচিত করতেন। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র যৌধেয়দের রাজ্যে ছিল না। যৌধেয় রাজ্যে ওই সময় তাদের নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন ছিল। যৌধেয়দের হাতে কুষাণদের পরাজয় হয়।
কুষাণ কারা?
কুষাণরা ছিল মধ্য এশিয়ার একটি যাযাবর গোষ্ঠী। কুষাণ রাজা কদফিসেস প্রথমে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে পহ্লবদের পরাজিত করে কিপিন ও কাবুল দখল করেন। এরপর তিনি ব্যাক্ট্রিয়ায় স্বীয় অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যাক্ট্রিয়া শব্দটি আসলে একটি প্রাচীন স্থান বা অঞ্চলের নাম, যা বর্তমান আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এটি হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং আমু দরিয়া নদীর (প্রাচীন অক্সাস নদী) মধ্যে অবস্থিত ছিল। এক সময় কুষাণ রাজ্যের রাজা হন সম্রাট কণিষ্ক। ধারণা করা হয় কণিষ্ক ১৫১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। তার পরবর্তী রাজারা ছিলেন বিশিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কণিষ্ক, দ্বিতীয় বাসুদেব প্রমুখ। কুষাণরা ছিল ধর্মতান্ত্রিক রাজকার্য চালানোর মতানুসারী। তারা রাজাকে দেবতাতুল্য বলে ঘোষণা দেন। ওই সময় উত্তর ভারতের বহু অঞ্চলের বাসিন্দা জাতি-গোষ্ঠী তা মেনে না নিয়ে বিদ্রোহ করে। উত্তরপ্রদেশে নাগ ও মাঘ বংশীয় রাজারা, পাঞ্জাবে যৌধেয় প্রমুখ বিদ্রোহ করে। ওই সময় যৌধেয়রাও কুষাণদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
যৌধেয়রা ছিল এমন একটি জাতি, যারা নিজেদের সামরিক শক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য ওই সময় এশিয়া অঞ্চলে পরিচিত ছিল। তারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তাদের সামরিক শক্তির কারণে তারা বহিরাগত শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তাই যৌধেয়দের এলাকায় বিদেশি শাসন কায়েম হয়নি, যদিও পরবর্তী সময়ে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যৌধেয়রা ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। যৌধেয়রা কুষাণ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কুষাণরা যৌধেয়দের কাছে হার মানে। যৌধেয়দের মূল ভূখণ্ড বর্তমান পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত ছিল। যৌধেয়দের রাজ্যটি ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। এই জাতি-গোষ্ঠী নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুশীলন করে আসছিল প্রাচীনকাল থেকে। তারা নিজেদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি বজায় রেখেছিল বহুকাল ধরে।
যৌধেয়রা যোদ্ধা ছিল, তবে তারা অন্য কোনো রাজ্য আক্রমণ করে নিজেদের আয়ত্তে নেয়নি। তবে বিদেশি শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য সমস্ত সামরিক আয়োজন তারা সব সময় প্রস্তুত রাখত। যৌধেয় রাজ্যে যে গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্ত বংশীয় সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আমলে। অহিচ্ছত্র, মথুরা বিজয়ের পর সমুদ্রগুপ্তের দৃষ্টি পড়ে সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরা যৌধেয় ভূমির ওপর। তিনি সংবাদমাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যৌধেয়দের কোনো রাজা নেই। রাজাহীন রাজ্য জয় করা সহজ ব্যাপার। তবে যৌধেয়দের রাজকার্য পরিচালনা থেকে শুরু করে যুদ্ধ, সন্ধি সহ সব বিষয়ে চূড়ান্ত নির্ণায়ক ছিল রাজ্যটির জনগণ।
যৌধেয়রা দেবপুত্র শাহি ও ক্ষত্রপদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কুণিন্দ (একটি রাজ্যের নাম) এবং অর্জুনায়নকে (একটি রাজ্যের নাম) মিলিত হয়ে একটি বিরাট গণসংঘের রূপ দিয়েছিলেন। যৌধেয়, কুণিন্দ এবং অর্জুনায়ন—তিনটি পৃথক রাজ্য ছিল, প্রতিটি স্বাধীনভাবে রাজকার্য পরিচালনার জন্য নিজস্ব গণসংঘ ছিল। তবে তারা বিদেশি আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এই তিনটি গণসংঘ ঐক্যবদ্ধ হয়। তাদের এই ঐক্য ছিল বজ্রের মতো অটুট।
ওই সময় সমুদ্রগুপ্ত ভেবেছিলেন রাজাহীন একটি রাজ্য তার বিশাল বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে না। তাই তিনি যৌধেয় রাজ্যে আক্রমণ চালান। যৌধেয়রা ছিল দেশপ্রেমিক, তাদের গণস্বাতন্ত্র্য তাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। যুদ্ধের সময় রাজ্যটির শুধু সৈন্যরা নয়, নারী-পুরুষ, শিশু সবাই অস্ত্র ধারণ করে। সমুদ্রগুপ্ত যখন যৌধেয় রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন, তখন নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সমুদ্রগুপ্তের সৈন্যরা নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে শুরু করে। যৌধেয়রা প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল, তাই তারা প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তোলে। পরম বিক্রমশালী বীর রাজা সমুদ্রগুপ্ত যৌধেয়দের প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। তিনি দূত মারফত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। তখন যৌধেয়রা জানায়, এই যুদ্ধবিরতি সাময়িক, কারণ স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য তাদের জনগণের মতামত প্রয়োজন। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাতে রাজি হন।
যৌধেয় গণপুরস্কর্তা (সভাপতি) জনমত নেওয়ার জন্য যৌধেয় রাজ্যের বিভিন্ন গণসংঘের কাছে খবর পাঠান। রাজ্যটির বিভিন্ন এলাকার গণসংঘের পুরস্কর্তা (সভাপতি) জনগণের মতামত নিয়ে যৌধেয় পুরস্কর্তার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। অনুরূপভাবে কুণিন্দ ও অর্জুনায়নের রাজ্যের সভাপতিরা জনমত গ্রহণ করেন। পরে এই তিন গণপুরস্কর্তা বৈঠকে মিলিত হয়ে একমতে পৌঁছান যে, তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত। তাই তিন পুরস্কর্তা একত্রিত হয়ে সন্ধিচুক্তির জন্য সমুদ্রগুপ্তের কাছে পত্র পাঠান। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। তিন পুরস্কর্তা ও তাদের সেনাপতি সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে মথুরায় যান আলোচনা করতে।
যৌধেয়দের গণতান্ত্রিক শাসনকার্যে শাসক নির্বাচনের পদ্ধতি ছিল অনেকটা বর্তমান সংসদীয় কায়দার মতো। যৌধেয় রাজ্যের এলাকাভিত্তিক গণসংঘ ছিল। এই গণসংঘের প্রধানকে বলা হতো পুরস্কর্তা (গণসংঘ প্রধান বা সভাপতি)। তিনি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন। তারপর এলাকাভিত্তিক নির্বাচিত পুরস্কর্তারা কেন্দ্রীয় প্রধান পুরস্কর্তা নির্বাচিত করতেন। পুরস্কর্তাসহ একটি গণসংঘ কমিটি রাজ্য পরিচালনার ভার নিতেন। কমিটি রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ দিতেন। প্রাচীন ভারতে সেই সময় যৌধেয় অঞ্চলে এভাবেই শাসনকার্য পরিচালিত হতো। তবে যৌধেয় অঞ্চলের প্রতিটি নাগরিকই যোদ্ধা ছিল। শিশু জন্মগ্রহণের পর তাকে তলোয়ার ধুয়ে পানি পান করানো হতো। তবে এরা যোদ্ধা হলেও জীবনকে ভালোবাসত বেশি, কারণ শিশুরা জন্মের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুশীলন করে বড় হতো।
যৌধেয়দের মধ্যে ধনী-দরিদ্র ছিল, তবে ব্যবধান তীব্রতর ছিল না। যৌধেয় রাজ্যের কোনো নাগরিক ক্ষুধার কষ্ট পেত না। গণসংঘের পুরস্কর্তা বিষয়টি দেখভাল করতেন। এলাকাভিত্তিক গণসংঘের সভায় এলাকার সমস্যাগুলো উপস্থাপিত হতো এবং সেখানেই সমাধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছিল। এই সময় পশুশিকার ছিল অন্যতম একটি পেশা। যৌধেয় শিকারিরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পশুশিকারের জন্য বন-জঙ্গলে প্রবেশ করতেন। দেখা যেত, একটি দল অনেক বেশি পশু শিকার করেছে, অন্য দল কোনো পশু শিকার করতে পারেনি। তখন তারা সবাইকে ডেকে শিকারকৃত পশুগুলো সমভাবে ভাগ করে নিতেন। কৃষিজমির মালিকানাও ছিল সামাজিকভাবে। যে অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করত, তারা মিলে ওই অঞ্চলের ভূমিতে কৃষিফসল ফলাতেন। উৎপাদিত ফসল সমভাবে বণ্টন করা হতো। আজ থেকে ১৮০০ বছর পূর্বে ভারতে এমন একটি রাজ্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। ইতিহাস গবেষক ও দার্শনিক পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখে গেছেন, যৌধেয় ছিল একটি শক্তিশালী গণরাজ্য এবং এর অবস্থান ছিল যমুনা-শতদ্রু ও চম্বল-হিমালয়ের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে। অশোক স্তম্ভের গায়ে নিজের অভিলেখ লেখার সময় সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত যৌধেয়দের নাম স্মরণ করেছেন। তবে পঞ্চম শতাব্দীতে এসে এই জাতিটির নাম আর শোনা যায়নি। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য এই রাজ্যটি দখল করে নেন। তারা ক্রোধানলে পড়ে এই জাতিটি ধ্বংস হয়ে যায়। যৌধেয়রা নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখন এই জাতিটির কোনো অংশ বা জনগোষ্ঠীর নিদর্শন ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্বলিত একটি জাতি এভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এই জাতির কাছ থেকে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ শেখার অনেক বিষয় আছে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
প্রথম প্রকাশ: সংবাদ, ০৮ জুলাই ২০২৫
মন্তব্য করুন