ঢাকা রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
রাজশাহীর ঔপনিবেশিক কুঠি

বাণিজ্য ও ইতিহাসের মেলবন্ধন

আবু ছালেহ শোয়েব
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫, ০৪:৫৭ পিএম
বড়কুঠি: রাজশাহীর প্রাচীন ঐতিহ্য
বড়কুঠি: রাজশাহীর প্রাচীন ঐতিহ্য

রাজশাহীর হৃদয়ে একসময় গড়ে উঠেছিল বিশাল বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যেখানে সুরের ধ্বনি মিশে ছিল ব্যবসার আসরে, আর কাঁপত ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্ত। এ শহরের ঐতিহাসিক কুঠিগুলো একসময় ছিল ডাচ ও ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল, যেখান থেকে রেশম, নীল এবং অন্যান্য মূল্যবান পণ্য চলে যেত বিদেশে। রাজশাহীর কুঠিগুলো শুধু এক যুগের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছিল না, বরং তারা ছিল শোষণ, সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতীক। এ স্থাপনাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন গাথা, যেটি আজও রাজশাহীর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাজশাহী শহরের ঐতিহাসিক কুঠিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা হলো বড়কুঠি। সতেরো-আঠারো শতকে ওলন্দাজ বণিকরা কুঠিটি রেশম ও নীল ব্যবসার জন্য নির্মাণ করেছিলেন। এটি শুধু বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল না, বরং ঔপনিবেশিক অতীতের সাক্ষী হিসেবে রাজশাহীর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অঞ্চলের নীলকুঠি ও রেশম কুঠিগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বেশকিছু কুঠি ছিল, যেমন বোয়ালিয়া, মতিহার, বিনোদপুর, সিরোইল, পানানগর, সারদা, বিড়ালদহ, নন্দনপুর, বিলমারিয়া, মুলাডুলী, খরচাকা, দুর্গাপুর, বাগমারা, আচিনঘাট, সুরষ্যা প্রভৃতি স্থানে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল বড়কুঠি, যা সে সময়ের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। আজও এ কুঠিগুলো শহরের ইতিহাসের অমূল্য নিদর্শন হিসেবে বিদ্যমান, যা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত পরিচায়ক হয়ে উঠেছে।

বড়কুঠি: রাজশাহীর প্রাচীন ঐতিহ্য

বড়কুঠি রাজশাহীর সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা, যা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ওলন্দাজ বণিকরা নির্মাণ করেছিলেন। ১৭৫৫ সালে ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতা দখল করার পর ওলন্দাজরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, কিন্তু পরে তারা পরাজিত হন। এরপর ১৮১৪ সালে ওলন্দাজরা বড়কুঠি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন। কোম্পানিটি ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত এটি তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বড়কুঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। পদ্মা নদীর তীরে, রাজশাহী কলেজ ও সাহেব বাজারের দক্ষিণে অবস্থিত ভবনটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মালিকানাধীন। ভবনটির মধ্যে ১২টি কক্ষ, দুটি বারান্দা ও একটি বড় সভাকক্ষ রয়েছে। এর আঙিনায় বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক উপাদান সংরক্ষিত আছে, যেমন কামান, যা ১৮৩৩ সালের পর সরিয়ে নেয়া হয়, তবে তিনটি এখনো রাজশাহী পুলিশ লাইনে সংরক্ষিত। ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে বড়কুঠি সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়। পরে ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বড়কুঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্লাব হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্থাপনাটির মালিকানা পরিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। বড়কুঠি ও অন্যান্য কুঠি রাজশাহী অঞ্চলের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলো শুধু বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেই নয়, বরং কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওলন্দাজরা ও পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা এ স্থাপনাগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। রাজশাহী অঞ্চলের সবার জন্য কুঠিগুলো ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য পরিচায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছোট কুঠি: এক ঐতিহাসিক সৌন্দর্য

রাজশাহী শহরের ছোট কুঠি, যার স্থাপত্য ও নকশা বড়কুঠির মতোই। তবে এটি বেশ ছোট, প্রায় ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট। কুঠিটির সম্মুখভাগের আটটি ডোরিক কলামের ওপর স্থাপিত এক প্রশস্ত বারান্দা এর স্থিতিশীলতা ও সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে। মূল কুঠির কেন্দ্রীয় ব্লকটি সামনের বারান্দার চেয়ে উঁচু এবং তার ওপর একটি ক্লেরেস্টরি জানালা পুরো কাঠামোটিকে আলোকিত করে তোলে। এর সামনের বারান্দা প্রশস্ত এবং সমর্থিত চারটি কোণ দিয়ে একটি সুন্দর কেন্দ্রীয় সিঁড়ি স্থানটিকে আরো কার্যকরী ও আকর্ষণীয় করে তোলে।

পানানগর নীলকুঠি: নীল স্বাক্ষর

রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলার পানানগর গ্রামে অবস্থিত পানানগর নীলকুঠি ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মাণ হয়েছিল। এখানে ইংরেজ বণিকরা নীল চাষ ও ব্যবসা পরিচালনা করতেন। স্থানীয় কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে নীল চাষে বাধ্য করানো হতো। যদিও আজকের দিনে নীলকুঠির কিছু অবশিষ্টাংশ দেখা যায়, তবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।

সরদাহ ছোট কুঠি: নীলকুঠির সদর দপ্তর

রাজশাহী জেলার সরদাহ ছোট কুঠি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৮১ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটি নীল চাষের জন্য নির্মাণ করে এবং ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটি অধিগ্রহণ করে। রাজশাহী অঞ্চলের ১৫২টি নীলকুঠির সদর দপ্তর হিসেবে এটি ব্যবহার হয়েছিল। সরদাহ ছোট কুঠি বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার হলেও এর আর্কিটেকচার ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও এক বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে।

মতিহার কুঠি: শোষণের নিদর্শন

মতিহার কুঠি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে অবস্থিত এবং এটি ১৭৮১ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা নির্মিত হয়। একতলা, আয়তক্ষেত্রাকার এবং ৭০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট এ কুঠির দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে একটি বারান্দা রয়েছে। এটি মূলত রেশম ও নীল ব্যবসার জন্য ব্যবহার হলেও বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

কাজলা কুঠি: এক নতুন রূপে

কাজলা কুঠি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি ঐতিহাসিক স্থান, যা বর্তমানে একটি ব্যক্তিগত বাসভবন হিসেবে ব্যবহার হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশেষভাবে রক্ষিত রয়েছে। কুঠিটি একটি সাধারণ আয়তাকার কাঠামো। এটি একটি বিস্তৃত ট্যাংকের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত, যা এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে তোলে। রাজশাহীর ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এক ধারাবাহিকতা রাজশাহী শহর এবং তার আশপাশের এলাকা একসময় ছিল নীল ও রেশম বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং এ কুঠিগুলো ছিল সে ব্যবসার মঞ্চ। ব্রিটিশ ও ডাচ শাসনামলে এসব কুঠিগুলোর মাধ্যমে তৎকালীন আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু এটি স্থানীয় জনগণের ওপর অত্যাচার ও শোষণেরও কেন্দ্র ছিল। আজও এসব কুঠির অবস্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেসব অতীত ঘটনা, যা রাজশাহীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছে।

রাজশাহীর ঐতিহাসিক কুঠিগুলো: ঔপনিবেশিক ক্ষত

রাজশাহীর ঐতিহাসিক কুঠিগুলোর স্থাপত্য, নকশা ও তাদের অন্তর্নিহিত ইতিহাস আমাদের অতীতের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশ ও ডাচ শাসনের সময়কার এসব কুঠি একসময় ছিল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক শোষণ এবং জনশোষণের কেন্দ্র, তবে এখন এগুলো রাজশাহী শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। ইতিহাসপ্রেমী ও সংস্কৃতির অনুসন্ধানকারীদের জন্য এগুলো এখন একটি জীবন্ত পাঠশালা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অতীতের স্মৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখে।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কোদালিয়া গণহত্যা / নগরকান্দার রক্তঝরা ইতিহাস

১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

১০

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

১১

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১২

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১৩

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

১৪

জনগণ আসলে কী চায়

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / সুধীর চন্দ্র মজুমদার

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / মহসিন আলী

১৭

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আবুল বাশার মহিউদ্দিন আহম্মদ

১৮

শহীদ বুদ্ধিজীবী / ফাদার লুকাশ মারান্ডি

১৯

বুরুঙ্গা গণহত্যা: ৯৪ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা

২০