মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পেছনে দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা ছিল। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে ১৪ মে বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসের অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের নতুন অধ্যায় রচনা করেন।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বার্তায় উল্লেখ করেন, “ভারত যে পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, তাতে পূর্ব বাংলার ঘটনাপ্রবাহ উপেক্ষা করা আমাদের জন্য কঠিন। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ মানবিক অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হবে—এটাই আমার প্রত্যাশা। পূর্ব বাংলার জনগণের দাবি ন্যায্য, এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব থাকা উচিত। এই দাবিকে বিশ্ববাসী অবশ্যই সমর্থন করবেন।”
ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য অমৃত নাহার ইন্দিরার বার্তা পড়ে শোনান। অধিবেশনে প্রতিনিধিদলের নেতা কৃষ্ণ মেনন বলেন, “পূর্ব বাংলায় কোনো গৃহযুদ্ধ চলছে না; সেখানে গুলি চালিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা হচ্ছে।”
ভারতের সহযোগিতা ও সমর্থনের আহ্বান
মুম্বাইয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে সমর্থন এবং স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ভারত সরকারকে আহ্বান জানানো হয়। সভায় বলা হয়, “ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তবে অন্যান্য দেশও একই পথে এগিয়ে আসবে।”
পিএসপি নেতা সমর গুহ বাংলাদেশের শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে সীমান্ত অঞ্চল ভ্রমণ শেষে কলকাতায় সাংবাদিকদের জানান, “বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে শরণার্থী সমস্যার গুরুদায়িত্ব ভারতের ওপরই বর্তাবে। এতে ভারতের পূর্বাঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, যা গোটা দেশে প্রভাব ফেলবে।”
এদিন কলকাতার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাহায্যার্থে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রমোদ চক্রবর্তী পরিচালিত নয়া জমানা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশের জন্য তহবিলে যুক্ত করা হয়।
শরণার্থী সমস্যায় জাতিসংঘের ভূমিকা
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিদল আসামের কাছাড় জেলায় শরণার্থীদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে শিলচরে সংবাদ সম্মেলনে জানায়, “ভারতকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।”
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পরিস্থিতি
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীকে সহকারী সামরিক শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
কক্সবাজারে চীনপন্থী ন্যাপের আহ্বায়ক মাহমুদুল হক চৌধুরী ন্যাপের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “যে দল পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাস করে না, তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত নয়।”
এদিন মৌলভীবাজারের কাগাবালা ইউনিয়নের নড়িয়া গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে হত্যা করে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, বরিশালের বাকাই গ্রাম, কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদীর পার, চৌদ্দগ্রাম, রাজশাহীর চারঘাট, এবং হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের নলুয়া চা-বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধ হয়।
ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী
১৪ মে ১৯৭১-এর এই ঘটনাগুলো শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই নয়, জাতির সংগ্রামী চেতনাকে প্রজ্বলিত করার অনন্য দৃষ্টান্ত। ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং শরণার্থী সংকটের মোকাবিলায় বিশ্ববাসীর ভূমিকা এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, পূর্বদেশ (১৫ মে ১৯৭১), আনন্দবাজার পত্রিকা (১৫ মে ১৯৭১)।
মন্তব্য করুন