‘ম্যাজিক’ শব্দটি বাংলাদেশে এখন বেশ চাউর হয়েছে। ইংল্যান্ডে বসে আমরা শুনি ইউনুস ম্যাজিক, নোবেল ম্যাজিক, উন্নয়ন ম্যাজিক—আরও কত কী!
ইতিমধ্যে অনেকগুলো ম্যাজিক আমরা দেখেও ফেলেছি। কিন্তু, আজ ১৪ মে আসছে আরও এক নতুন ম্যাজিক। চট্টগ্রাম বন্দরে, এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নিজ গ্রাম এবং জোবরা গ্রামে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বন্দর ম্যাজিক
এক সপ্তাহ আগে বিডা ও বেজার চেয়ারম্যান ঘুরে এলেন চট্টগ্রাম বন্দর। উনি ঘোষণা দিলেন, দুবাইয়ের DP World, সিঙ্গাপুরের PSA, ইউরোপের Maersk Line, সৌদি আরবের RSGT সহ বিশ্বের সব নামকরা পোর্ট অপারেটররা ছুটে আসছে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায়। এটাই হচ্ছে ইউনুস ম্যাজিক!
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, নির্মিতব্য বে টার্মিনালে DP World এবং PSA–এর সঙ্গে চুক্তি বিগত সরকার আমলেই হয়েছে। গত আগস্টের পট পরিবর্তনের পর প্রক্রিয়া কিছুটা কমে গিয়েছিল।
সেটাকে চাঙা করার জন্যই জোরেশোরে লেগেছে বর্তমান সরকার এবং দাবি করছে ইউনুসের ডাকে ওরা সবাই ছুটে আসছে। ব্যাপারটা আসলে মোটেই তা নয়।
RSGT তো কাজ শুরু করেই দিয়েছে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালে। ডিপি ওয়ার্ল্ড শুরু করেছে নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে। Maersk Line লালদিয়া চরে গড়ে তুলছে তাদের পোর্ট। তাহলে নতুন কী হচ্ছে?
গত ১ এপ্রিল যমুনা ভবনে নৌ মন্ত্রণালয়, বেজা, বিডা, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর ও অন্যান্য সবাইকে নিয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ সভা ডেকেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। আহ্বান জানিয়েছিলেন উপরের সব প্রকল্প আগামী আগস্টের মধ্যে দৃশ্যমান করতে হবে। কিন্তু সব কি আর সম্ভব?
তবুও, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ২২ এপ্রিল মহাসমারোহে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর করল। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের মেয়াদকাল শুরু হয়েছে ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে এবং শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৯।
কাজেই বন্দর সেক্টরে কোনো ম্যাজিক দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্যই চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক সবাই এখন বলছে, “এক কোম্পানি রান্না করে বাড়ে, আরেক কোম্পানি খায়।”
উপরের ঘটনাগুলো মূলধারার মিডিয়ার সবারই জানা আছে। বিশেষতঃ বন্দর বিট যারা কভার করেন। কিন্তু কেউ কিছুই লিখতে পারবেন না। কারণ, ৫৩ বছরে তারা এখনই সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছেন। কাজেই সবাই বলবেন, এটা ইউনুস ম্যাজিক! এটা নোবেল ম্যাজিক!
বিনিয়োগ ম্যাজিক!
উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগ নিয়ে তো প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, “আমি আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়। আমি বড় মাঠের খেলোয়াড়।” সবাই আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসবে। কিন্তু, বেজার ওয়েবসাইট অনুযায়ী বিগত সরকারের আমলেই ৬৮টি সরকারি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠিত হয়েছে। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়েছে ৩২টি, এর মধ্যে কার্যকর হয়েছে কমপক্ষে ১০টি। এছাড়া চট্টগ্রামের মিরেরশ্বরাইতে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ৩৩,৮০৫ একর জমিতে গড়ে উঠছে। যেখানে জাপান নিয়েছে ৫০০ একর জমি।
এছাড়াও, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গড়ে উঠেছে ২টি সরকারি অঞ্চল। চীনের জন্য আনোয়ারায় গড়ে উঠছে আরও একটি জোন এবং আড়াই হাজার একর জমিতে গড়ে উঠেছে জাপানের অর্থনৈতিক অঞ্চল। এর সাথে কোরিয়ান ইপিজেড তো ৮০’র দশক থেকেই আছে।
কাজেই ছোট যাদুকর আশিক চৌধুরী যা দেখিয়ে দেশ মাতিয়েছেন, তার কোনোটাই তাদের করা নয়। বলা যায়, তারা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন। কিন্তু কার্যকর করতে পারবেন তো? বিনিয়োগকারীরা কিন্তু দ্বিধান্বিত। অন্তবর্তীকালীন সরকার আমলে তারা আসবে কি?
সুন্দর স্ক্রিপ্ট
বন্দর আর বেজার ম্যাজিকের পর উনি যাবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। শোনা যাচ্ছে, একটা ডি.লিট বা কিছু একটা দেওয়া হবে। এরপর যাবেন গ্রামীণ ক্ষুদ্র ঋণের জন্মস্থান জোবরা গ্রামে। ওখানে নাকি সব বয়স্ক মহিলাদের একত্রিত করার আয়োজন হয়েছে। সবাই তাদের জীবনের গল্প বলবে। সবশেষে নিজ গ্রামে।
স্ক্রিপ্টটা সুন্দর হয়েছে। তাঁর সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে মায়াবী এক পরিবেশ তৈরি করবেন। অনেক জায়গায়ই চোখের জলও থাকবে।
জাপান ম্যাজিক
ম্যাজিক এখানেই শেষ নয়। এরপর আছে জাপান ম্যাজিক। ২৯ মে যাবেন টোকিও। সম্মোহন আরেক ম্যাজিক এখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী টোকিও ট্রায়ালে বাঙালি আইনজীবী রাধা বিনোদ পালের আবক্ষ মূর্তি পরিদর্শন ও শ্রদ্ধা জানানো। মূল উদ্দেশ্য—জাপানিদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমাদের অতীত সম্পর্ক এবং তাদের কৃতজ্ঞতাকে পুঁজি করা।
বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার নাম না বললেও পূর্ববর্তী সকল সরকারের সাথে জাপানের সম্পর্ক মনে করিয়ে দেওয়া। আসল উদ্দেশ্য দ্রুত এয়ারপোর্টের থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন। এটাও তো তাদেরই সৃষ্টি!
ম্যাজিকের ফলাফল কী?
এত বড় যাদুকরের যাদুর ফলাফল তো খুব ভালো না। জাতিসংঘের মহাসচিব ছুটে এলেন তাঁর ডাকে। ধন্য ধন্য পড়ে গেল সারা দেশে। মাথায় টুপি দিয়ে ইফতার করলেন লাখ রোহিঙ্গার সাথে। ঘোষণা এল ১ লক্ষ ৮০ হাজার ফিরবে। তারা আগামী ঈদ করবে রাখাইনে।
দেখা গেল, হয়নি। উল্টো প্রস্তুতি চলছে মানবিক করিডরের আর ইতিমধ্যেই নতুন রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে ১ লক্ষ দশ হাজার।
ডেভোস সম্মেলন থেকে আসার পর তো প্রায় বিশ্বজয়। ৩২ রাষ্ট্রপ্রধান লাইন ধরে দেখা করেছেন নোবেল বিজয়ীর সাথে। ফলাফল আসার পরপরই ট্যারিফ বেড়ে গেল ইউরোপীয় দেশগুলোতে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সভা করেও হুলুস্থুল। বাচাল প্রেস সচিবকে দিয়ে কূটনৈতিক বক্তব্য দিয়ে মহাধরা খাওয়া। সবাই বলল, সব মিথ্যা বলছে। এই প্রেস সচিব গোয়েবল্সকেও হারিয়ে দেবে।
ম্যাজিক আর রাষ্ট্রক্ষমতা এক নয়
রাষ্ট্রক্ষমতায় ম্যাজিক দেখানো যায় না। এখানে কিছুক্ষণ কিছু মানুষকে সম্মোহন করা নয়। সুন্দর সুন্দর বচন শুনে বিনিয়োগ আসবে না—শুধু হাততালি পাওয়া যাবে।
কাজেই নিত্যনতুন ম্যাজিক বাদ দিয়ে বাস্তবতায় আসুন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলতে হবে। আপনি টেনেসি অঙ্গরাজ্যের ন্যাশভিলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সিটিজেন কমিটি গঠন করেছিলেন। আপনি ওয়াশিংটন ডিসি-র পথে পথে প্রচার করেছেন, অর্থ তুলেছেন। ব্যাল্টিমোর ব্লকেডেও নাকি আপনি ছিলেন।
ক্ষমতার লোভে এসব কিছু ভুলে যাবেন নোবেল ম্যাজিশিয়ান? গোলাম আজমের পূর্ব পাকিস্তানে আপনি প্রধান উপদেষ্টা! ছিঃ লজ্জা! কারো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। জীবনে অর্জিত সম্মানটি অক্ষুণ্ণ রাখুন, ম্যাজিশিয়ান!!!
মন্তব্য করুন