মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রয়াস ও অজস্র ঘটনার সমাবেশ রয়েছে। এখানে তুলে ধরা হলো ১৯৭১ সালের এই দিনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি জানিয়ে ২১ মে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া), যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ জাতিসংঘের মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলে তাঁরা নিশ্চিত।
কলকাতায় শিক্ষকদের সমাবেশ
বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দেওয়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এই দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে তারা ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। এর সভাপতি নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। সমিতির লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধকে সহযোগিতা করা, জনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থী শিক্ষকদের সাময়িক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এই সভায় কয়েক শতাধিক বাংলাদেশি শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।
হোসেন আলীর বক্তব্য
ভারতে স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধান হোসেন আলী এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের আবেদনই বাংলাদেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রমাণ। তিনি আশ্বাস দেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানি সেনামুক্ত হলেই শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে যাবে।
ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য
ব্রিটিশ সরকার পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ভারতে ১ কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় মুদ্রার সমপরিমাণ সাহায্যের ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘের মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই সাহায্য দেওয়া হয়েছে বলে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র জানান।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন শরণার্থীদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন এবং তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানান। এ বৈঠকে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহি পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং নারী-শিশুসহ বহু শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।
বিশ্ব জনমত তৈরিতে জয়প্রকাশ নারায়ণ
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব সফররত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশ
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচিতে দেশটির পূর্বাংশে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরুর আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, পূর্ব পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জীবনযাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। তবে তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের দুই অংশে একসঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব নয়।
চীনের কনসাল জেনারেল চ্যাং ইং পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযান
২১ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদানদী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাদ্য ও রসদবাহী একটি রেলওয়ে ট্রলিতে আক্রমণ চালিয়ে গোলাবারুদ দখল করেন।
কুমিল্লার গৌরীপুরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দলের ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন।
এছাড়া কুমিল্লার দেবীদ্বার থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের এক গেরিলা অভিযানে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হন।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই; দৈনিক পাকিস্তান, ২২ ও ২৪ মে ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২২ মে ১৯৭১।
মন্তব্য করুন