একাত্তরের প্রতিটি দিনই ছিল ইতিহাসের অংশ। স্বাধীনতার পক্ষে দেশ-বিদেশে গৃহীত নানা উদ্যোগ এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ যুদ্ধের মিশ্রণেই গঠিত হয়েছিল বিজয়ের পথ। ২১ এপ্রিলের ঘটনাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী—বিশেষ কূটনৈতিক প্রতিনিধি
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বৈদেশিক জনমত গঠনের জন্য ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জাতিসংঘে ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা ছিল তার মূল দায়িত্ব।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়া বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার খবর শুনে তিনি পাক সরকারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিষয়টি তুলে ধরেন।
বিশ্বনেতাদের প্রতি মাওলানা ভাসানীর বার্তা
মুক্তাঞ্চল থেকে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বের বড় বড় নেতাদের কাছে বার্তা পাঠান। তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং গণহত্যা বন্ধে চাপ প্রয়োগ করতে তাদের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর এবং বাংলাদেশের জনগণকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করার অনুরোধ করেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই দিনে লন্ডনে আইরিশ শ্রমিক নেতা ড. কোনার ক্রুইজ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে ‘দমনমূলক’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেন। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার শরণার্থীদের সহায়তায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়। কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি সমাবেশে বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবীরা।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রতি সমর্থন জানান। এছাড়া পাকিস্তানের কিছু রাজনীতিবিদ সেনাবাহিনীর পক্ষে বিবৃতি দেন। অন্যদিকে, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন পাকিস্তান সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বার্তা পাঠান।
যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে যশোরের নাভারনে পাকিস্তানি সেনাশিবিরে হামলা চালায়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হিঙ্গুলি সেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করেন।
তবে, পাকিস্তানি বাহিনী উত্তরবঙ্গের হিলি, পঞ্চগড় এবং কিশোরগঞ্জ দখল করে নেয়। তারা রাঙামাটির বন্দুকভাঙ্গা ও ফরিদপুরের গোয়ালন্দ ঘাটেও অবস্থান শক্তিশালী করে। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি ও সরঞ্জামের অভাবে কিছু এলাকায় পিছু হটতে বাধ্য হন।
সার্বিক চিত্র
একাত্তরের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর-বাহিরে ঘটেছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করার নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মমতা এবং এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছে।
মন্তব্য করুন