মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহে উঠে এসেছে বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও জনগণের ঐকান্তিক অংশগ্রহণ। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল ছিল এমনই এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন, যখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।
এদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে একটি ১৮ দফা নির্দেশনামা জারি করেন। শত্রুকবলিত এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় বিবেচনা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি, কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-আধাসামরিক সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের, নৌ-যোগাযোগ ও অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা না করার, গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গোয়েন্দা তথ্য পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। জ্বালানি বিক্রিসহ সামরিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ ছিল স্পষ্ট।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের যুদ্ধ একই দিনে মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন ‘দ্য ব্যাটল অব কুষ্টিয়া’ শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে কুষ্টিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক প্রতিরোধ ও সাফল্যের বিবরণ দেন প্রতিবেদক ড্যান কগিন। এ বিজয় মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে মনোবল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তানি রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক সভায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তার ভূমিকা জোরদারের আহ্বান জানান। এদিকে ঢাকায় কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও মালিক মোহাম্মদ কাশেম গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। একই দিন ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ কর্মকর্তাদের নাম ঘোষণা করা হয়।
মাঠের লড়াই: পাবনা ও সিলেটে তীব্র যুদ্ধ এই দিনে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পাইকরহাটি (বর্তমানে শহীদনগর) এলাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে বাধা দিলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে নগরবাড়ীতে ফিরে যায়। যুদ্ধে ইপিআরের হাবিলদার ইমদাদ উদ্দিন, নায়েক মফিজউদ্দিন, ল্যান্স নায়েক আতিয়ার রহমানসহ আরও কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নেতৃত্ব দেন সুবেদার গাজী আলী আকবর।
পরে পাকিস্তানি বাহিনী রাতের আঁধারে পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং পরদিন পাইকরহাটি ও আশপাশের গ্রামগুলোতে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ চালায়। শতাধিক গ্রামবাসী নিহত হন, রামভদ্রবাটি, কোড়িয়াল, বড়গ্রাম ও সাটিয়াকোলা গ্রামে চলে ভয়াবহ নির্যাতন।
সিলেট ও কুষ্টিয়ায় সংঘর্ষ সিলেটের সালুটিকর বিমানঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে সারা দিনব্যাপী লড়াই হয়। একপর্যায়ে বিমান হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এছাড়া কুষ্টিয়ার দর্শনায়ও মুখোমুখি সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে পিছু হটে গেলে পাকিস্তানি বাহিনী লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ১, ৩, ৭ ও ৮); বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, ফজলুল কাদের কাদেরী; দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ এপ্রিল ১৯৭১
মন্তব্য করুন