মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি বিজয়ের পেছনে রয়েছে দেশি-বিদেশি বহু মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রয়াস, অসংখ্য বিস্ময়কর ঘটনা। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রাণ উৎসর্গ করেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল।
মেজর খালেদ মোশাররফের (পরবর্তীতে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জ, উজানিসর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অ্যান্ডারসন খালের পাশ দিয়ে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। ১৪ এপ্রিল স্থল, বিমান ও নৌপথে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক হামলা চালায়। গঙ্গাসাগর প্রতিরক্ষা অবস্থানে দরুইন গ্রামে আলফা কোম্পানির ২ নম্বর প্লাটুনের সেকশন কমান্ডার হিসেবে মোস্তফা কামাল দায়িত্বে ছিলেন।
১৭ এপ্রিল সকাল থেকেই শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ। সঙ্গে নামে বৃষ্টি। প্রতিরোধে শাফায়াত জামিল পাঠান ডি কোম্পানির ১১ নম্বর প্লাটুন। সারা দিন চলে তুমুল যুদ্ধ।
পরদিন সকালে বৃষ্টির মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা দরুইন গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেও মোস্তফা কামাল সেখানেই থেকে যান। তিনি বলেন, তাঁর চেয়ে সহযোদ্ধাদের প্রাণের মূল্য বেশি।
তাঁর গুলিতে বহু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তবে এক পর্যায়ে তাঁর গুলি ফুরিয়ে যায় এবং তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বাংকার থেকে ধরে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে।
পাকিস্তান উপহাইকমিশন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথগ্রহণের পর ভারতের কলকাতায় কর্মরত পাকিস্তানের বাঙালি উপহাইকমিশনার হোসেন আলী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে উপহাইকমিশনের আরও চারজন কর্মকর্তা ও প্রায় ৬০ জন কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসেন।
তাঁরা ৯ নম্বর পার্ক সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে উপহাইকমিশন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং নামফলক পরিবর্তন করে নতুন করে লেখেন—‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মিশন’।
বাংলাদেশের স্বীকৃতির আহ্বান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী কাশীকান্ত মৈত্র এবং সিপিআই (এম) নেতা জ্যোতি বসু বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। জ্যোতি বসু বলেন, শুধু স্বীকৃতিই নয়, বাংলাদেশকে অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সহায়তাও দেওয়া উচিত।
এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সমাজসেবীরা—তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, বিচারপতি শঙ্করপ্রসাদ মিত্র, ড. রমা চৌধুরীসহ ১৩ জন ব্যক্তি শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান।
একই দিনে ইসলামাবাদে ব্রিটিশ হাইকমিশন ঘোষণা দেয়, পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ২১ এপ্রিল রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্মদিন উদ্যাপন করা হবে না।
ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং মুম্বাইয়ে সাংবাদিকদের জানান, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি আর শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখা যায় না। অল ইন্ডিয়া সিভিল লিবার্টিসের সভাপতি এন সি চট্টোপাধ্যায় কিটিংয়ের বক্তব্যকে স্বাগত জানান।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৮ এপ্রিল রাতে বেতারে দেওয়া ভাষণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান জানান, ভারতীয় দাসত্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত রাখতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে। অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করাই তাদের লক্ষ্য।
সামরিক কর্তৃপক্ষও নাগরিকদের মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দেওয়ার জন্য আবারও নির্দেশ জারি করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। সীতাকুণ্ডে চলে দিনভর সংঘর্ষ। রাঙামাটির কুতুবছড়িতে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছয়টি ট্রাক লক্ষ্য করে অ্যামবুশ চালালে কয়েকজন সেনা নিহত এবং কয়েকটি গাড়ি ধ্বংস হয়।
পিপিপির প্রতিক্রিয়া লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি দাবি করেন, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা অনেক আগেই গ্রহণ করেছিল। তিনি বলেন, ১৫-২৪ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা চালালেও, সেই সময় ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতীকগুলো ধ্বংস করা হচ্ছিল। ২৩ মার্চ শহরের সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয় এবং শেখ মুজিব নিজেকে সার্বভৌম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
সূত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র (খণ্ড ২, ১২, ১৩), বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ১, ২, ৮), দৈনিক পাকিস্তান (১৯ এপ্রিল ১৯৭১), আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা (১৯ এপ্রিল ১৯৭১)
মন্তব্য করুন