জোলা সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রথমে পাঠ্যপুস্তকে কালজয়ী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পটির মাধ্যমে। মহেশ গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে—‘গ্রামের নাম কাশীপুর। গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবু, দাপটে তাঁর প্রজারা টুঁ শব্দটি করিতে পারে না এমনই প্রতাপ।
ছোট ছেলের জন্মতিথি পূজা। পূজা সারিয়া তর্করত্ন দ্বিপ্রহর বেলায় বাটী ফিরিতেছিলেন। বৈশাখ শেষ হইয়া আসে, কিন্তু মেঘের ছায়াটুকু কোথাও নাই, অনাবৃষ্টির আকাশ হইতে যেন আগুন ঝরিয়া পড়িতেছে।
সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে। অগ্নিশিখার মত তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে মাথা ঝিমঝিম করে যেন নেশা লাগে।
ইহারই সীমানায় পথের ধারে গফুর জোলার বাড়ি। তাহার মাটির প্রাচীর পড়িয়া গিয়া প্রাঙ্গণ আসিয়া পথে মিশিয়াছে এবং অন্তঃপুরের লজ্জাসম্ভ্রম পথিকের করুণায় আত্মসমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছে।...’
গফুর জোলার সংসারের অন্যতম সদস্য গরু ‘মহেশ’ আর মেয়ে আমিনা। ভুপেন হাজারিকা পরাধীন যুগের হতদরিদ্র গফুর মহেশ আর আমিনাকে নিয়ে স্বাধীন দেশে তারা কেমন আছে তার গানে এ প্রশ্ন রেখেছেন শরৎ বাবুর কাছে। আমি বাংলাদেশে আমজনতার বাজেট বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও প্রাণিসম্পদেও উন্নয়ন প্রত্যাশা করেও ‘গফুর আর মহেশের’ বাজেট চেয়ে লেখা লিখেছি। আগে ফ্রান্সের মশহুর ঔপন্যাসিক এমিলি জোলাকে ( ১৮৪০-১৯০২) আমি একসময় জোলা মনে করতাম। পরে প্যারিসে তার পারিবারিক সংগ্রহশালায় যেয়ে ভুল ভাঙে। জোলা জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যশস্বী লেখক হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁতি, কারিকর কিংবা জোলা সম্প্রদায়ের কেউ ছিলেন না!
ছোটবেলায় আমার পাঠ্যসাথীদের মধ্যে দু-একজন ছিল জোলা বা কারিকর পেশাধারী পরিবারের সদস্য। তবে তখনো বা এখনো তারা ততটা দরিদ্র সম্প্রদায় নয়, যতটা শরৎ বাবুর গফুর ছিল। জেলা সাতক্ষীরার নলতা এখন একটি সমৃদ্ধ জনপদ। ১৯৩৫ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাধক খানবাহাদুর আহছানউল্লা (১৮৭৩-১৯৬৫) ‘আহছানিয়া মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ জনপদের জোলা বা কারিকর সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নের সূত্রপাত ঘটাতে।
জোলা কথাটা এসেছে ফার্সি জুলাহ বা জুলাহা শব্দ থেকে, যার অর্থ তাঁতি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে ঐতিহ্যবাহী পারদর্শী পেশাজীবী মুসলমান তাঁতি, যাদের মসলিনের মতো সূক্ষ্ম বস্ত্র বয়নে সুখ্যাতি ছিল। ইতিহাসে পাই ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি মূলত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি পদ্ধতিতেই চালিয়েছিল শাসনকার্য। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ এবং ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস করেও ভারতে খাদ্যকে রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ বা হাতিয়ার হিসেবে বাংলার কৃষিপণ্য রফতানি করার মাধ্যমে ব্রিটেনে আমদানি করে সেখানে কৃষিজাত সামগ্রী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে এ দেশে তীব্র খাদ্য সংকট তৈরির প্রয়াস চলে, যা ’৭৬-এর মন্বন্তর নামে খ্যাত। এছাড়া ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল এক্সপোর্ট বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে ইম্পোর্ট পণ্য হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে বাংলার তাঁত শিল্পকে শেষ করেও দেয়া হয়। এদেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। ব্রিটিশ আমলেই বাংলার সৃজনশীল ও স্বনামধন্য পেশাজীবী তাঁতি বা কারিকর সম্প্রদায় শেষমেশ অতিদরিদ্রে নিপতিত হয়। বাংলায় তাদের জোলা বলা হতো।
জোলা প্রায়ই একটি সাম্প্রদায়িক গালি, অন্য পেশার মানুষ জোলা বলে আনন্দ পেয়ে থাকে, অনেকটা হেয় করে থাকে, এ দেশে যারা বস্ত্র তৈরি করত তারা হয়ে গেল জুলা।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বাংলাপিডিয়া’য় গবেষক বনানী বিশ্বাসের ‘দলিত সম্প্রদায়’ এন্ট্রিতে দেখা যায় জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার মানুষ আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ করে পণ্ডিতদের কাছে ‘দলিত’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশে দুই ধরনের দলিত জনগোষ্ঠী রয়েছে: ১. বাঙালি দলিত ২. অবাঙালি দলিত। বাংলাদেশে বসবাসরত দলিতদের সংখ্যা বর্তমানে ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন। বাঙালি দলিত বলতে সমাজে যারা অস্পৃশ্য তাদের বোঝায়, যেমন চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, রানা কর্মকার, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি সম্প্রদায় সমাজে অস্পৃশ্যতার শিকার। এসব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। ইসলাম ধর্ম জাতিভেদকে অস্বীকার করলেও এ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকে পেশার কারণে সমাজে পদদলিত হয়ে রয়েছে যেমন জোলা, হাজাম, বেদে, বাওয়ালি।
তাঁত শিল্প নিয়ে কাজ করা ‘লুঙ্গিওয়ালা’ ব্লগে এক লেখক লিখেছেন: জোলা পরিবারে জন্ম আমার। আর ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি জোলারা বোকা। একটু বড় হয়ে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর বইয়ে পড়েছি বোকা জোলা আর শিয়ালের গল্প। সে গল্পে জোলার বোকামি দেখে অনেক হেসেছি। স্কুলে, কলেজে জোলা বলে বন্ধুরা উপহাসও করেছে। কিন্তু জোলা পরিচয় নিয়ে কখনো হীনম্মন্যতায় ভুগিনি। আমার সম্প্রদায়ের কাউকেই দেখিনি এটা নিয়ে আফসোস করতে।
ছোটবেলায় জানতে চেয়েছি, জোলার সঙ্গে বোকামির যোগসূত্র কোথায়। কেউ বলতে পারেনি। কয়েকদিন আগে পেয়ে গেলাম বোকামির এ যোগসূত্র। সেটা দিলেন ইংরেজ জেমস ওয়াইজ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে তিনি ঢাকার সিভিল সার্জন ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে পেশায় একজন চিকিৎসক। কিন্তু সামাজিক ইতিহাস নিয়ে তার ছিল অগাধ আগ্রহ। সে আগ্রহ থেকেই তিনি ‘নোটস অন দ্য রেসেস, কাস্টস অ্যান্ড ট্রেডস অব ইস্টার্ন বেঙ্গল’ নামে একটি বই লেখেন। সেখানেই জোলাদের বোকামির কিছু গল্প তুলে ধরেছেন।
জেমস ওয়াইজের বইটি প্রকাশ হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। লন্ডনের সেন্ট মার্টিন লেনের হার ম্যাজেস্ট্রিস প্রিন্টার হ্যারিসন অ্যান্ড সন্স থেকে। মাত্র ১২ কপি ছাপা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে, বইটি খুব রেয়ার। এ বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেছেন ফওজুল করিম। বাংলা অনুবাদের নাম: পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ।
বইটিতে জেমস ওয়াইজ জানাচ্ছেন, জোলাদের আহাম্মকির অনেক মজার মজার গল্প চালু আছে। সেখান থেকে তিনি ঢাকায় বহুল প্রচলিত একটি গল্প তুলে ধরেছেন। সে গল্পটি হচ্ছে:
ঢাকার অনতিদূরে ড্যামরার তাঁতিপাড়ার একদল জোলা রাতের বেলায় পালাতে গিয়ে কী করে বোকামির জন্যে পারেনি। রাতের অন্ধকারে তারা নৌকায় উঠল। উদ্দেশ্য গ্রাম থেকে পালাবে। কিন্তু নৌকাটি যে কিনারে দড়ি দিয়ে লগির সঙ্গে বাঁধা আছে, এটা খেয়াল করল না। রাতভর দাঁড় বইল। কিন্তু সকালে দেখে, তারা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। তাজ্জব ব্যাপার। অনেক মাথা খাটিয়ে তারা বের করল, তারা পালাতে চাইলে কী হবে, ড্যামরা তাদের ছাড়তে চাইছে না।
এতদিন মুসলমান তাঁতিদের জোলা বলে জানতাম। কিন্তু জেমস ওয়াইজের বইটিতে তাঁতি আর জোলাদের আলাদা করে দেখা হচ্ছে। সেখানে তাঁতিদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখা হয়েছে, জোলাদের থেকে মুসলমান তাঁতিদের কওম স্বতন্ত্র। তাঁতিরা বানায় জামদানি বা নকশা তোলা কাপড়। জোলারা বানায় মোটা মসলিন। একসঙ্গে এরা খাওয়া-দাওয়া করলেও এদের মধ্যে বিয়েশাদি হয় না। তাঁতিদের জোলা বললে ভীষণ চটে যায়। কারিকর কিংবা জামদানি তাঁতি বললে খুশি হয়।’
আবার তাঁতি আর জোলাদের তাঁতের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। জেমস ওয়াইজ জানাচ্ছেন, তাঁতিদের তাঁত জোলাদের থেকে আলাদা। তাঁতিদের তাঁত হলো দুই সানাই ও দুই প্যাডেল বিশিষ্ট। তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট কাপড় বোনা যায় এ তাঁতে। তবে বাংলাপিডিয়ায় মুসলমান তাঁতিদেরই জোলা বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘হিন্দু ও মুসলিম’ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁতিদের দেখা পাওয়া যায়। মুসলিম তাঁতিদের ‘জোলা’ নামে ডাকা হয়। এ নাম মুসলিম তাঁতিরা পছন্দ করেন না, নিজেরা সে নামে পরিচিতও হতে চান না। ‘জোলা’ নামের পরিবর্তে তারা নিজেদের কারিকর বলতেই অধিক পছন্দ করেন।
মোগল আমলে ঢাকার তাঁতিদের হাতে জামদানি কাপড় ব্যাপক উৎকর্ষ লাভ করে। মূলত মুসলিম তাঁতিরাই জামদানি বানাতেন। তারা জামদানিতে যে নকশা ফুটিয়ে তুলতেন, তার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন পারস্যের সাসানীয় সম্রাটদের সময়ে পারস্যের প্রচলিত নকশা ডিজাইনের সঙ্গে। এসব কারণেই হয়তো মুসলমান তাঁতিদের সঙ্গে জোলা শব্দটি জুড়ে গেছে। এ তাঁতিরা যে ভীরু ও অসহায় ছিল, তার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৭৩ সালে ঢাকার প্রধান মিস্টার রুজের চিঠিতে। তিনি লিখেছেন: সাধারণভাবে তাঁতিরা অসহায় ও ভীরু প্রকৃতির। বেশির ভাগ হলো চরম দরিদ্র। ব্যবসার হিসার রাখতে তারা অক্ষম। সহজভাবে এরা কঠোর পরিশ্রমী। নির্যাতিত হলে রুখে দাঁড়াতে জানে না। নিয়োগকর্তার কাছ থেকে যদি ন্যায় ও মানবিক আচরণ পায় এবং একটানা পরিশ্রমে তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের মতো উপার্জন হয়, তাহলেই তারা খুশি।
প্রায় ২৫০ বছর আগে মিস্টার রুজের লেখায় যে-জোলা, তাঁতিদের দেখি, তাদের অবস্থার যে খুব পরিবর্তন হয়েছে, তেমন নয়! জোলারা আজও বোকা-দরিদ্র রয়ে গেছে। ফড়িয়াদের কাছে আজও তারা উৎপাদিত কাপড় সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রম করে পরিবারের জীবিকা নির্বাহের মতো উপার্জন করতে পারলেই তারা খুশি থাকছে।
প্রয়াত লেখক ও আমলা আকবর আলি খান যখন বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ছিলেন, তখন তিনি আমার কাছে বাংলার দাস বা ক্রীতদাস, জোলা, কারিকর, নরসুন্দর, ঋষি সম্প্রদায় সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত জানতে চাইতেন। তার স্নেহধন্য হিসেবে এ ব্যাপারে গবেষণায় তিনি উৎসাহ দিতেন। সত্যিকার অর্থেই জোলা সম্প্রদায় নিয়ে আলোচনা ও চর্চা হওয়া এখন সময়ের দাবি।
প্রথম প্রকাশ : বণিক বার্তা
মন্তব্য করুন