ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

পহেলা বৈশাখ: যেদিন বাঙালি তার শিকড়ের কাছে ফিরে যায়

মঙ্গল শোভাযাত্রা
মঙ্গল শোভাযাত্রা

বাংলা নববর্ষ—পহেলা বৈশাখ—আজ যেমন বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার গভীরে প্রোথিত একটি উৎসব, এর সূচনা কিন্তু ছিল একদম ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখি, পহেলা বৈশাখের জন্ম হয়েছিলো একান্তই প্রয়োজনের তাগিদে, যা সময়ের প্রবাহে রূপ নিয়েছে একটি সার্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক উৎসবে।

শিল্পীর চোখে দরবারে সম্রাট আকবর এবং তার নবরত্নরা Image source: scroll.in/article

মুঘল আমলে বাংলা সনের উদ্ভব বাংলা সনের গোড়াপত্তন ঘটে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬–১৬০৫)। তখন ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হতো হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকা, যা চাঁদের গতিপথ অনুযায়ী মাস নির্ধারণ করত। কিন্তু এই চান্দ্র বছর কৃষিভিত্তিক রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। কারণ চান্দ্র বছর গ্রেগরিয়ান বা সৌর বছরের তুলনায় প্রায় ১১ দিন ছোট হওয়ায় কৃষি মৌসুম অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হত অসম্ভব। ফলে রাজস্ব আদায় নিয়ে দেখা দিত বিশৃঙ্খলা ও কৃষকের অসন্তোষ।

এই জটিলতা নিরসনে সম্রাট আকবর রাজসভায় উপস্থিত বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের পরামর্শে ১৫৮৪ সালে হিজরি ৯৯২ সনের ১০ বা ১১ মার্চ হতে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। এটি মিশ্র পঞ্জিকা হিসেবে পরিচিত—চান্দ্র ও সৌর বছরের সমন্বয়ে প্রণীত। তবে ব্যবহারিক প্রয়োজনে এই সন গণনা কার্যকর ধরা হয় ৫ এপ্রিল ১৫৮৪, এবং ঐ দিনই বাংলা সনের প্রথম দিন বা ১ বৈশাখ হিসেবে ধরা হয়।

এই সনটি পরবর্তীতে পরিচিত হয় “ফসলি সন” বা “বাংলা সন” নামে। এটি কৃষি ও রাজস্ব আদায়ের জন্য একটি যথাযথ সময়চক্র নির্ধারণ করে দেয়, ফলে কৃষক ও প্রশাসক—উভয়ের জন্যই এটি হয়ে ওঠে সুবিধাজনক।

ফসলি নববর্ষ থেকে লোকজ উৎসবে রূপান্তর

ফসলি নববর্ষে চাষাবাদ ও খাজনা নির্ধারণের সাথে সম্পর্কিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ধীরে ধীরে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হতে থাকে। জমিদাররা এই দিনে ‘হালখাতা’র আয়োজন করতেন, যেখানে প্রজারা পুরনো দেনা মিটিয়ে নতুন খাতায় নাম লেখাতেন, বিনিময়ে মিষ্টিমুখ করানো হতো। এই অনুশীলন থেকেই গড়ে ওঠে বৈশাখের দিনটিকে ঘিরে একটি সামাজিক আচার এবং লোকজ উৎসবের ভিত্তি।

বিশেষ করে পূর্ববাংলায়, যা আজকের বাংলাদেশ, পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় নববর্ষ মানে ছিল নতুন ফসলের প্রত্যাশা, আগামীর স্বপ্ন ও পুরনো ঋণমুক্ত জীবনের সূচনা।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে নববর্ষের ভূমিকা

ব্রিটিশ আমলে বাংলা সনের গুরুত্ব খানিকটা কমলেও প্রাদেশিক পর্যায়ে হালখাতা ও মেলার ঐতিহ্য অব্যাহত ছিল। তবে পাকিস্তান শাসনামলে (১৯৪৭–১৯৭১) বাঙালির সাংস্কৃতিক চর্চার ওপর যখন এক ধরনের আরোপিত চাপ আসতে থাকে, তখন পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক।

এই সময়ে ছায়ানট সংগঠনটি ঢাকার রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু করে ১৯৬৭ সালে, যা কালক্রমে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়। পাকিস্তানি শাসকদের ইসলামিক সংস্কৃতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলা সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরতে পহেলা বৈশাখ ছিল এক নীরব সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

স্বাধীন বাংলাদেশের নববর্ষ

স্বাধীনতা অর্জনের পর পহেলা বৈশাখ রাষ্ট্রীয় উৎসবে রূপ নেয়। ১৯৮৭ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে শুরু হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’, যা ২০১৬ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক “Intangible Cultural Heritage” হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়।

পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি: নতুন বছরের আগমনে বাঙালির ঘরে ঘরে উৎসবের রঙ বাংলা নববর্ষের আগমন মানেই শুধু একটি দিন নয়—এটি একটি দীর্ঘ প্রস্তুতির অংশ, যেটি শুরু হয় বৈশাখের আগের সপ্তাহগুলো থেকেই। আবহমান বাংলার ঘরোয়া সংস্কৃতি, সামাজিক বন্ধন এবং লোকজ ঐতিহ্য এই প্রস্তুতিতে জড়িয়ে থাকে গভীরভাবে।

ঘরবাড়ি পরিস্কার ও পরিবেশ সাজানো

নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হলো ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা। এটি শুধু বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতাই নয়, বরং একটি প্রতীকী রীতি—পুরোনো ময়লা, দুঃখ, গ্লানি ও ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে নতুন সম্ভাবনা, আনন্দ ও আশার বার্তা গ্রহণের প্রস্তুতি। ঘরদোর সাজাতে ব্যবহৃত হয় আলপনা, রঙিন কাগজের ফুল, বেণী, কাঁচ বা মাটির তৈজসপত্র। অনেক পরিবারে শিশু-কিশোরেরা দেয়ালে আঁকে রঙিন বৈশাখী দৃশ্য—পাখি, ফুল, গাছ, নদী ও গ্রামীণ জীবনের চিত্র।

নতুন পোশাক কেনা ও বৈশাখী ফ্যাশন

বৈশাখ মানেই নতুন পোশাক। নারীরা পরে শাড়ি, বিশেষ করে লাল-সাদা বা রঙিন শাড়ি, আর পুরুষেরা পরে পাঞ্জাবি-পাজামা বা ফতুয়া। ছোটদের জন্যও কেনা হয় বৈশাখী জামা। পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে বৈশাখী গয়না, হাতে চুড়ি, কপালে টিপ, আর মাথায় ফুলের মালা এক বিশিষ্ট সাজের অংশ। শহরাঞ্চলে এখন অনেকেই বিষয়ভিত্তিক থিমে সাজে—যেমন ফুল, বাঘ, গ্রামবাংলা, লোকজ ঐতিহ্য।

ফ্যাশন হাউসগুলোতে এই সময় চলে বৈশাখী কালেকশন বিক্রির ধুম। বুটিক থেকে শুরু করে হকার—সবাই প্রস্তুত থাকে বৈশাখের বাজারকে ঘিরে।

বৈশাখী খাবার ও মিষ্টান্ন প্রস্তুতি

পহেলা বৈশাখে খাবার-দাবারও বিশেষ মাত্রা পায়। পান্তা-ইলিশ এই সময়ের প্রতীকী খাবার হিসেবে পরিগণিত হলেও অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্য রয়েছে। কেউ কেউ রান্না করেন খিচুড়ি, গরুর মাংস, মোরগপোলাও, অথবা দুধ-চিড়া। কিন্তু সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ঘরে তৈরি মিষ্টান্ন—পায়েস, নারিকেল নাড়ু, রসগোল্লা, চিতই বা পাটিসাপটা পিঠা ইত্যাদি।

বাড়িতে অতিথি আসা বা আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় এদিন, তাই রান্নাঘরে চলে ব্যস্ততা। খাবার শুধু স্বাদের নয়, এটি হয়ে ওঠে সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করার বাহন।

হালখাতা: ব্যবসায়ী সমাজের নববর্ষ

বাংলাদেশে নববর্ষ মানেই ব্যবসায়ীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রেওয়াজ—হালখাতা। এটি মূলত পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন বছরের জন্য নতুন খাতা খোলার অনুষ্ঠান। প্রাচীনকাল থেকেই এটি প্রচলিত, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দোকানদারদের মধ্যে। প্রজারা বা ক্রেতারা দোকানে এসে পুরনো দেনা শোধ করেন, আর ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখ করান, অনেক সময় একটি ছোট উপহারও দেন।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী—সব জায়গায় হালখাতাকে ঘিরে থাকে উৎসবমুখর পরিবেশ। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দোকান সাজায় ফুল, রঙিন বাতি ও ফেস্টুন দিয়ে। অনেক জায়গায় তো মিছিল বা আয়োজন হয় 'নববর্ষের শুভেচ্ছা' জানিয়ে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ সময় প্রস্তুতি নেয় বর্ষবরণের আয়োজনের জন্য। গান, নাচ, নাটক, কবিতা আবৃত্তি—সবকিছুর মহড়া চলে নিয়মিত। চারুকলা অনুষদে চলে মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ ও অন্যান্য প্রতীক তৈরির কাজ। পাড়া-মহল্লায় বৈশাখী মেলার আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়, যেখানে থাকে হস্তশিল্প, খেলনা, খাবার আর গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন।

রমনার বটমূলে সূর্যবন্দনা

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ঢাকার রমনা উদ্যানের সেই পুরনো, ছায়াময় বটগাছ—যার পাদদেশে প্রতি নববর্ষের ভোরে উচ্চারিত হয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনন্য আহ্বান: “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো”।

এই আয়োজনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সূচিত হয় নতুন দিনের যাত্রা, যেখানে মিলেমিশে যায় সংগীত, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও একটি জাতির অদম্য আত্মার প্রতিধ্বনি।

রমনা বট্মূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ Image source: wikipedia.org by অভিজিৎ দাস

ছায়ানটের সূচনা: সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের একটি অধ্যায়

রমনার বটমূলের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৬৭ সালে, একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে। তখনকার পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল ইসলামীকরণ নীতির রূঢ় প্রয়োগ। রবীন্দ্রসংগীত, বাঙালির লোকজ রীতিনীতি ও ভাষাচর্চা সবকিছুকেই দমন করার চেষ্টা চলছিল।

এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অথচ দৃঢ় এক প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছায়ানট নামের সংগঠনটি। তাদের আহ্বানে ১৯৬৭ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ ১৩৭৪) ভোরে ঢাকার রমনা উদ্যানের প্রাচীন বটমূলে আয়োজন করা হয় প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। সেখানে গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের গান—যেমন “এসো হে বৈশাখ” ও “তুমি নেবে কতবার বলো”। শ্রোতা-দর্শকদের সাড়া ছিল অভাবনীয়। বটমূলে গেয়ে ওঠা এই গানগুলো যেন হয়ে ওঠে প্রতিরোধের ভাষা, এক আত্মজাগরণের অগ্নিস্নান।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রূপান্তর

প্রথম আয়োজনেই যে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। পরবর্তী বছরগুলোতে এই আয়োজন পরিণত হয় বর্ষবরণের অনিবার্য অংশে। ছায়ানটের শিল্পীরা ঘোর লাগা ভোরে একে একে পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, লালনগীতি ও বাংলা লোকগান। অনুষ্ঠান শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ” গান দিয়ে—যেটি যেন এক প্রতীকী আহ্বান: পুরোনো ক্লেশ, গ্লানি আর সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে নতুন আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার ডাক।

এই আয়োজন এখন শুধু ঢাকার কেন্দ্রেই সীমাবদ্ধ নয়; দেশের নানা প্রান্তে রমনার বটমূল অনুপ্রাণিত করেছে অনেককে। আজ অনেক জেলা শহরেও তৈরি হয়েছে ‘রমনার বটমূলের প্রতিরূপ’—যেখানে অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সংস্কৃতিকে ঘিরে বর্ষবরণ।

রমনার ভয়াল দিন: ২০০১ সালের হামলা

রমনার বটমূলের ইতিহাস শুধু আনন্দ আর সংগীতের নয়, এটি বেদনারও সাক্ষী। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখের সকালে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন নিরীহ মানুষ, আহত হন শতাধিক। এই হামলা ছিল বাঙালির সংস্কৃতির ওপর এক সরাসরি আঘাত।

তবে এই ট্র্যাজেডির পরেও থেমে থাকেনি ছায়ানট। বরং আরও দৃঢ় প্রত্যয়ে, আরও বৃহৎ জনসমাগমে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই অনুষ্ঠান। এটি প্রমাণ করে—সংস্কৃতিকে হত্যা করা যায় না, ভয় দেখিয়ে বাঙালির আত্মাকে দমন করা যায় না।

আজকের রমনার বটমূল: রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় ঐতিহ্য

বর্তমানে রমনার বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির রূপ পেয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবাই এই আয়োজনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

প্রচুর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও লাখো মানুষ প্রতি বছর এই আয়োজন উপভোগ করে। বাঙালির জাতিগত পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক হিসেবে এই অনুষ্ঠান আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রমনার বটমূলের বর্ষবরণ উঠে এসেছে অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের এক বিরল উদাহরণ হিসেবে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা: বাঙালির পথনাট্য হয়ে ওঠা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

পহেলা বৈশাখ মানেই যেমন নতুন বছরের আগমন, তেমনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও বর্ণিল অনুষঙ্গ হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সূচিত এই শোভাযাত্রা আজ কেবল ঢাকার নয়, বরং সমগ্র জাতির সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো একে “ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা বাঙালির গর্ব ও আত্মপরিচয়ের অন্যতম প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুভ শক্তির বিজয় ঘোষণায় যাত্রা

“মঙ্গল শোভাযাত্রা” শব্দটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে এর উদ্দেশ্য—‘মঙ্গল’ অর্থ শুভ এবং ‘শোভাযাত্রা’ অর্থ এক আনন্দঘন র‌্যালি বা মিছিল। এই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করা হয় সকল অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির আহ্বান। নানা রঙের মুখোশ, বিশালাকৃতি পশুপাখির মূর্তি, পৌরাণিক চরিত্রের অনুকরণ, দানবাকৃতির প্রতিকৃতি—সব কিছু মিলে তৈরি হয় এক অসাধারণ লোকজ শিল্প ও পথনাট্যর মেলবন্ধন।

শুরু হয়েছিল এক প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে

১৯৮৯ সালে সামরিক শাসনের অস্থির প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করেন। সে সময় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিল তরুণ শিল্পীরা। চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হাতে বানানো মুখোশ, পাপেট, ব্যানার ও প্রতীক নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, যেখানে প্রকাশ পেয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবাদ ও শুদ্ধ সংস্কৃতির বার্তা।

এই সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি অচিরেই রূপ নেয় সার্বজনীনতায়। বছরের পর বছর এটি আরও পরিণত হয়, আরও বর্ণিল হয় এবং একসময় হয়ে ওঠে জাতীয় বর্ষবরণের কেন্দ্রীয় অনুষঙ্গ।

শোভাযাত্রার উপাদান ও শিল্পধারা

মঙ্গল শোভাযাত্রার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর বৈচিত্র্যময় লোকজ শিল্পরূপ। এটি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি হয় চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের প্রচেষ্টায়। কিছু বিশেষ উপাদান প্রতিবছরই দেখা যায়—

বাঘের মুখোশ: শক্তি ও সাহসের প্রতীক পাখির প্রতিকৃতি: মুক্তির অভিপ্রায় মাছ বা কচ্ছপ: গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সংযুক্ততা দানব বা অসুর আকৃতির মূর্তি: অশুভ শক্তির প্রতীক, যাকে মাটির, কাগজের ও বাঁশের কাঠামোতে রূপ দেয়া হয় চাকা ও রঙিন চৌকো ডিজাইন: সময়ের প্রবাহ ও চক্রের প্রতীক

এছাড়াও থাকে নানা ধরনের পটচিত্র, ফেস্টুন, ব্যানার এবং স্লোগান—যেখানে উঠে আসে সামাজিক বার্তা যেমন “সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক”, “শান্তি চাই”, “প্রকৃতিকে রক্ষা করো” ইত্যাদি।

জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক

২০১৬ সালে ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে “Representative List of the Intangible Cultural Heritage of Humanity” তালিকাভুক্ত করে। এই স্বীকৃতি কেবল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে নয়, বরং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিকামী ও মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরে।

বর্তমানে শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট এমনকি প্রবাসেও এই শোভাযাত্রার আদলে আয়োজন করা হয় মঙ্গলযাত্রা। এটি পরিণত হয়েছে বাঙালির সার্বজনীন ঐতিহ্যে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়।

শিল্প, সংস্কৃতি ও প্রতিবাদের মিলনমেলা

মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু চোখধাঁধানো শিল্পকর্ম নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলন, এক জাগরণের ডাক। যখন সমাজে বিভাজন, বৈষম্য বা অন্যায় বাড়ে—তখন এই শোভাযাত্রার প্রতীকগুলো হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা। শিল্পের মাধ্যমেই মানুষ একত্র হয়, চেতনার জায়গায় দাঁড়িয়ে উঠে বলে—“শুভ হোক শুরু, অশুভ হোক অবসান।”

মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন কেবল একটি রঙিন আয়োজন নয়—এটি বাঙালির চেতনার এক জীবন্ত প্রতীক। চারুকলা অনুষদের ক্যাম্পাস থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা আজ পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। যখন ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সুর বাজে, আর বিশাল চোখওয়ালা পাপেট এগিয়ে চলে বটতলার পথ ধরে—তখন সেই দৃশ্য কেবল এক উৎসব নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান।

গ্রামীণ উৎসব ও নাগরিক প্রাণ: বৈশাখে বাংলার প্রাণের মিলন

পহেলা বৈশাখ শুধু শহুরে রঙের উৎসব নয়, এটি গ্রামবাংলার হৃদয় থেকে উৎসারিত এক প্রাণোচ্ছল আনন্দধারা। নববর্ষ উদযাপন গ্রামীণ জীবনে যেমন প্রাচীন ঐতিহ্যে গাঁথা, তেমনি শহরজীবনে তা হয়ে উঠেছে নাগরিক প্রাণের উৎস। এই দুই প্রান্তের মিলনে বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সত্যিকারের জাতীয় উৎসব—যেখানে ধ্বনিত হয় বাংলার মাটি ও মানুষের ঐক্যের সুর।

গ্রামবাংলার বৈশাখ: মাটির গন্ধে উৎসবের বর্ণ

বাংলার গ্রামগুলোতে পহেলা বৈশাখ মানেই এক ব্যতিক্রমী দিন। দিনটির শুরু হয় গ্রামের মন্দিরে বা মাঠে আয়োজিত পূজা-পার্বণ বা সামাজিক প্রার্থনায়। এরপর সারা গ্রাম যেন জেগে ওঠে আনন্দে—চালু হয় গ্রামীণ মেলা, গান-বাজনা, পান্তা-ইলিশের ভোজন, আর হরেক রকমের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।

গ্রামীণ বৈশাখের প্রধান আকর্ষণগুলো

মেলা: বৈশাখী মেলাগুলোতে থাকে বায়স্কোপ, হস্তশিল্প, খেলনা, বাঁশি, মাটির পুতুল, নাগরদোলা ইত্যাদি। মেলাগুলো কেবল বিনোদন নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতিরও বড় চালিকা শক্তি।

খাদ্য উৎসব: ভোরবেলা খোলা আকাশের নিচে খাওয়া হয় পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ, সঙ্গে থাকে শুকনো মরিচ, আলুভর্তা, শুঁটকি কিংবা ঘরোয়া আচার। এই আয়োজন কখনো কখনো পরিণত হয় মহল্লা বা গ্রামের যৌথ ভোজে।

লোকক্রীড়া প্রতিযোগিতা: গ্রামে বৈশাখ মানেই হাডুডু, দড়ি টানাটানি, মোরগ লড়াই, বালিশ খেলা, দৌড় প্রতিযোগিতা, কানামাছি, আর শিশুদের কৌতুকদায়ী খেলাধুলা। এসব আয়োজন শুধু বিনোদন নয়, এক সামাজিক মিলনমেলাও বটে।

গানের আসর ও যাত্রাপালা: বৈশাখী মেলাগুলোতে হয় লোকগান, বাউল গান, কবিগান কিংবা যাত্রাপালার আয়োজন। অনেক জায়গায় রাতভর গান চলে; সারা গ্রাম যেন সুর আর ছন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতিচ্ছবি

গ্রামের বৈশাখের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয় এই উৎসবে। ধর্মের ব্যবধান ভেঙে পড়ে একটি সাংস্কৃতিক বন্ধনে। উৎসবের দিনটিকে ঘিরে তৈরি হয় মিলনমেলা, যেখানে কেউ অতিথি নয়—সবাই স্বজন।

নগরের বৈশাখ: আধুনিক রূপ, ঐতিহ্যের টান

একইসঙ্গে শহরগুলোতেও পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় বর্ণাঢ্য আয়োজনে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বড় শহরগুলোতে থাকে—

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ও পথনাট্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈশাখী বাজার ও পোশাকের ধুম ফ্যামিলি আউটিং, ছবি তোলা, সামাজিক মিডিয়ায় ভাগাভাগি

তবে এই শহুরে উৎসবেও গ্রামীণ অনুষঙ্গ বিদ্যমান—লাল-সাদা পোশাক, পান্তা-ইলিশ, বাংলা গান, শিকড়ের টান। নগরের মানুষও এই দিনটিতে ফিরে যেতে চায় একটুকরো মাটির ঘ্রাণে।

গ্রাম হোক বা শহর, পহেলা বৈশাখে বাংলার মানুষ একত্রিত হয় স্মৃতি, সংস্কৃতি ও সত্তার মিলনে। গ্রামীণ উৎসবের সরলতা আর নাগরিক উদযাপনের আধুনিকতা মিলেমিশে তৈরি করে এক জাতিগত বন্ধন। এই উৎসব শুধু বিনোদন নয়—এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিচয় এবং মানুষের হৃদয়ের এক মেলবন্ধন।

বৈশাখ আমাদের শিখিয়ে দেয়—আমরা সবাই একই গাছের ডালপালা, শিকড় আমাদের এক। বৈশাখ মানেই প্রাণের উৎসব, সব বিভেদ ভুলে মিলনের আমন্ত্রণ।

পহেলা বৈশাখের রাজনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য: উৎসব থেকে ঐক্যের প্রতীক

পহেলা বৈশাখ—বাংলা বছরের প্রথম দিন—আজ আর কেবল একটি ঋতু পরিবর্তনের উৎসব নয়। এটি হয়ে উঠেছে বাংলা সংস্কৃতির এক অখণ্ড রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা। এই দিনটি বাঙালি জাতির জন্য একটি সংস্কৃতি-নির্ভর গণচেতনার প্রকাশ, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে সবাই একত্রিত হয় একটি অভিন্ন পরিচয়ে: “আমি বাঙালি”।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ

পহেলা বৈশাখ বরাবরই সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে এক প্রতীকী অবস্থান হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই উৎসবে ধর্মীয় বিভাজনের কোনো স্থান নেই—এটি এক সর্বজনীন আয়োজন, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নেয় সমানভাবে। বিশেষত যখন মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো এই উৎসবকে আঘাত করার চেষ্টা করেছে, তখন সাধারণ মানুষ বৈশাখী মেলায়, শোভাযাত্রায়, গান-নৃত্যে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাহসিকতার বার্তা দিয়েছে।

এই প্রতিরোধের ভাষা ছিল না অস্ত্র, বরং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি—যেটি ছিল আরো শক্তিশালী, আরো স্পষ্ট।

গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক

বাঙালির জাতীয় চেতনার ভিত্তি রচিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। পহেলা বৈশাখ সেই ধারাবাহিকতার এক সাংস্কৃতিক স্তম্ভ। কারণ এই দিনটি—

ব্যক্তিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় পরিচয়ের উপলব্ধি ঘটায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে মানুষের সংহতি গড়ে তোলে জনসাধারণের অংশগ্রহণে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদযাপনের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার চর্চার মঞ্চ হয়ে ওঠে বিশেষত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়গুলোতে পহেলা বৈশাখ ছিল এমন একটি দিন, যেখানে সব মত, পথ ও পক্ষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে বলেছে—“সংস্কৃতির মঞ্চে আমরা এক”।

সমাজ বদলের চেতনায় বৈশাখ

বৈশাখী উৎসব সমাজে মানবিকতা, সাম্য, মিলন ও সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তোলে। গ্রাম ও শহরের বিভাজন, ধনী-গরিবের ব্যবধান, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ফারাক—এই দিনটিতে মুছে যেতে দেখা যায়। এটি এক অনন্য সামাজিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে:

একই পান্তা-ইলিশ খেয়ে ধনী-গরিব হাসে একই শোভাযাত্রায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটে শিল্পী, কৃষক, শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী একই মঞ্চে গান গায় লোকশিল্পী ও নগর কবি এই উদযাপন মানুষকে সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে আত্ম-পরিচয় ও সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত করে।

সংগ্রামের ইতিহাসে বৈশাখ

এদেশের ইতিহাসে পহেলা বৈশাখ এসেছে বারবার সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে। যেমন--

১৯৮৯ সালে চারুকলার ছাত্রদের প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ ২০০১ সালে রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানস্থলে সন্ত্রাসী বোমা হামলার পর, মানুষ আরো দৃঢ়ভাবে বলেছে—“এই উৎসব আমাদের অধিকার” প্রতি বছর মৌলবাদীদের হুমকি বা বিরোধের মধ্যেও মানুষ সগর্বে বর্ষবরণ করে, যা একটি নির্বাক সাংস্কৃতিক বিপ্লব

উৎসব যখন চেতনার প্ল্যাটফর্ম

পহেলা বৈশাখ একটি চেতনার দিন—যেখানে বাঙালি সংস্কৃতির আলোকিত, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, এবং গণতান্ত্রিক রূপ প্রকাশিত হয়। এটি শুধু নাচ-গান বা মেলা নয়; এটি একটি সমাজ পরিবর্তনের প্রতীক। বৈশাখের দিন জাতি বলে ওঠে—

“আমরা এক, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের শক্তি।”

এই উৎসব আমাদের শেখায়—অসাম্প্রদায়িকতা কোনো রাজনীতিবিদ নয়, মানুষের সংস্কৃতির ভেতরেই বেঁচে থাকে। এবং সেই সংস্কৃতি যতদিন টিকে থাকবে, বাঙালি ততদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ: বৈশাখের উৎসব যখন বাধা ডিঙিয়ে এগোয়

পহেলা বৈশাখ আজ এক সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হলেও, এই উদযাপনের পথ বরাবর সহজ ছিল না। প্রতিবছর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন লক্ষ মানুষের মিলন ঘটে, অন্যদিকে নিরাপত্তা, জনসমাগম ব্যবস্থাপনা, ও মৌলবাদী হুমকির মতো নানা চ্যালেঞ্জ-এর মুখোমুখি হতে হয় আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীদের।

তবে এসব প্রতিকূলতার মুখেও থেমে থাকেনি বৈশাখ। বরং এসব বাধা পেরিয়েই আরো শক্তভাবে ফিরে আসে এই বাঙালির প্রাণের উৎসব।

১. জনসমাগম ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা

ঢাকা শহরসহ বড় বড় নগরে পহেলা বৈশাখে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটে। এর ফলে প্রতি বছর প্রশাসনের সামনে বিরাট এক জননিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়।

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার ছায়ানটের অনুষ্ঠান, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, হাতিরঝিল—এসব জায়গায় বিশাল জনজট তৈরি হয়।

অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে বাড়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি, হারিয়ে যায় শিশু বা প্রবীণ, অনেক সময় নারী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।

এজন্য সরকার উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যেমন—

বিশেষ পুলিশ মোতায়েন সিসিটিভি ও ড্রোন পর্যবেক্ষণ ওয়াচ টাওয়ার, চেকপোস্ট অনুষ্ঠান শেষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এলাকা ত্যাগের নিয়ম তবে এতো আয়োজনের মাঝেও অনেক সময় বিশ্রাম, পানির ব্যবস্থা বা জরুরি মেডিকেল সাপোর্টের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়।

২. ধর্মীয় উগ্রবাদ ও মৌলবাদী বিরোধিতা

পহেলা বৈশাখে সর্বজনীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকাশ অনেক মৌলবাদী গোষ্ঠীর চক্ষুশূল। অতীতে কয়েকটি ঘটনা এই চ্যালেঞ্জকে স্পষ্ট করেছে--

২০০১ সালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছিল, যাতে নিহত হন ১০ জন, আহত হন অনেক।

বিভিন্ন সময় উগ্রবাদী প্রচারণা ও হুমকি এসেছে, বৈশাখকে "অইসলামিক" আখ্যা দিয়ে। কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী বৈশাখী সাজ-পোশাক, নারীর অংশগ্রহণ, বা লোকায়ত গানের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে।

তবে বাঙালি জাতি বারবার সাংস্কৃতিক ঐক্য দিয়ে এর জবাব দিয়েছে। বর্ষবরণে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এবং সামাজিক সচেতনতা মৌলবাদী প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করেছে।

৩. বাণিজ্যিকীকরণ ও বৈশাখের মূল আবেদন হারানোর আশঙ্কা

বর্তমান সময়ে পহেলা বৈশাখ অনেকাংশেই বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। যেমন—

ফ্যাশন হাউসগুলো বৈশাখকে ঘিরে লাল-সাদা পোশাকের প্রতিযোগিতায় নামে খাবারের দোকানে পান্তা-ইলিশের অতিরিক্ত দাম হয়ে পড়ে সাধারণের নাগালের বাইরে প্রকৃত লোকসংস্কৃতির চেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ বা "গ্ল্যামারাইজড" সংস্কৃতি স্থান পাচ্ছে শহরের বৈশাখে। এই বাণিজ্যিকীকরণে আদিবাসী, প্রান্তিক কিংবা গ্রামীণ বৈশাখ অনেক সময় আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

৪. পরিবেশ ও ভোগবাদিতা

মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত রঙিন কাগজ, প্লাস্টিক, ডিসপোজেবল পণ্যে শহরের পরিবেশ দূষিত হয়। উৎসবের নামে ভোগবিলাস, অপচয় অনেক সময় মূল বার্তাকে চাপা দেয়। এজন্য এখন দরকার পরিবেশবান্ধব উৎসব আয়োজন এবং শিকড়মুখী চিন্তা।

চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অগ্রগতি: “উৎসব থেমে থাকেনি”

এসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখ প্রতিবারই ফিরে আসে নতুন উৎসাহ ও সৃজনশীলতায় ভর করে। এটি প্রমাণ করে--

সংস্কৃতি কখনো চাপা পড়ে না, বরং প্রতিরোধ ও প্রতিবাদে আরো শক্তিশালী হয়। মানুষের অংশগ্রহণই সবচেয়ে বড় জবাব মৌলবাদ, নিপীড়ন কিংবা দমননীতির বিরুদ্ধে একটানা চর্চার মধ্য দিয়েই উৎসবের পরিচয় বজায় থাকে, গভীর হয় সমাজে এর প্রভাব

চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আশাবাদের আলো

পহেলা বৈশাখ যেমন আনন্দের, তেমনি তা একটি সামাজিক সাহসিকতার উদাহরণ। নিরাপত্তা, মৌলবাদ, ভিড় কিংবা বাণিজ্যিকীকরণ—সবকিছুকে মোকাবেলা করেই বাঙালি বলে ওঠে:

“এই উৎসব আমার অধিকার, আমার চেতনা, আমার পরিচয়।” বর্ষবরণ তাই শুধু নতুন বছরের সূচনা নয়—এটি এক সংগ্রামী জাতির প্রতিবাদ, মিলন এবং আশাবাদের প্রতীক।

পহেলা বৈশাখের সূচনা হয়েছিলো রাজস্ব নীতির প্রয়োজনে, তবে সময়ের ব্যবধানে এটি হয়ে উঠেছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। কৃষক থেকে নাগরিক, জমিদার থেকে কর্মজীবী—সবাই এই দিনে একাত্ম হন একটি সংস্কৃতিতে, একটি চেতনায়। পহেলা বৈশাখ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের গল্প বলে—একটি দিন, যেদিন বাঙালি তার শিকড়ের কাছে ফিরে যায়।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চুকনগর গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার ইতিহাস

২০ মে ১৯৭১: লাল টকটকে রক্তে ভেসে গিয়েছিল ভদ্রা নদীর পানি

১৯৭১ সালের ১৯ মে: শরণার্থী সংকট ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

শহীদ বুদ্ধিজীবী / তরফদার আতিয়ার রহমান

শহীদ বুদ্ধিজীবী / খাজা আবদুস সাত্তার

শহীদ বুদ্ধিজীবী / সুব্রত সাহা

শহীদ বুদ্ধিজীবী / বলহরি দাশ

সোহরাওয়ার্দী একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বন্ধুত্ব চেয়েছিলেন

শহীদ বুদ্ধিজীবী / ইসলাম উদ্দিন

শহীদ বুদ্ধিজীবী / উজির আলী মালিথ্যা

১০

শহীদ বুদ্ধিজীবী / খন্দকার রেজাউন নবী

১১

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আবুল কাশেম মণ্ডল

১২

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার পদ্মানদীর মাঝি

১৩

উলানিয়ার সেই কিশোর

১৪

১৮ মে ১৯৭১: পাকিস্তানের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিবাদ

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / দীনেশচন্দ্র রায় মৌলিক

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আয়েজ উদ্দিন

১৭

শহীদ বুদ্ধিজীবী / কে এম রফিকুল ইসলাম

১৮

শহীদ বুদ্ধিজীবী / বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্য

১৯

পুলিৎজার জিতল পার্সিভাল এভারেটের উপন্যাস ‘জেমস’

২০