ঢাকা রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান উড়ছেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমছে

বদরুল আলম, বনিক বার্তা
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫, ০৭:৩১ পিএম
ছবি: বণিক বার্তা
ছবি: বণিক বার্তা

২০২৪ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসে ৪১ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ন্ত বিমান থেকে লাফ দেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে তার ওই স্কাইডাইভ গিনেস বুকে বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি পায় গত বছরের ১ জুলাই।


২০২৪ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসে ৪১ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ন্ত বিমান থেকে লাফ দেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে তার ওই স্কাইডাইভ গিনেস বুকে বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি পায় গত বছরের ১ জুলাই। এর কয়েক মাস পর ১২ সেপ্টেম্বর চৌধুরী আশিক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান।

আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আশিক চৌধুরী নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর বিনিয়োগ বিষয়ে একের পরে এক প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডে উদ্যোগী হন। বিনিয়োগ আকৃষ্টের হিটম্যাপ তৈরিসহ যার মধ্যে রয়েছে ইনভেস্টমেন্ট সামিট আয়োজন, স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা পেতে ইলোন মাস্কের স্টারলিংকের নিবন্ধন, শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক মহাকাশ অনুসন্ধানে নাসার সঙ্গে চুক্তি, সব বিনিয়োগ প্রচারণা সংস্থাকে একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা। এ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন লজিস্টিক অবকাঠামো শক্তিশালী করতে চট্টগ্রাম বন্দরে ডেনমার্কভিত্তিক এপি মোলার মায়ের্স্কের বিনিয়োগ। নিত্যনতুন এমন সব উদ্যোগ নিয়ে চৌধুরী আশিক সাড়া ফেলে দিয়েছেন। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে হইচই চোখে পড়ার মতো।

নিয়োগ পাওয়ার পর গত সাত মাসে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে অনেক ধরনের কর্মযজ্ঞে হাত দিয়েছেন আশিক চৌধুরী। তবে বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রচারণামূলক ওইসব কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন প্রকৃত বিনিয়োগ আকৃষ্টে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের সূচক হিসেবে বিডায় নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবের সংখ্যা যেমন নিম্নমুখী, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) নিট প্রবাহও কমেছে। অন্যদিকে শিল্পের মূলধনি যন্ত্র আমদানিও নিম্নমুখী। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ আকৃষ্টে চৌধুরী আশিকের প্রচারণা বা তৎপরতা যতটা আলোচিত হচ্ছে, প্রকৃত বিনিয়োগ পরিস্থিতি তার ঠিক বিপরীত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস জুলাই থেকে মার্চে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ ছিল ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে ২৬ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উইকলি সিলেকটেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস জুলাই থেকে মার্চে মূলধনি যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি বা আমদানি বাবদ অর্থ পরিশোধ হয়েছে ১৫২ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল ২১৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের। অর্থাৎ মূলধনি যন্ত্র আমদানি কমেছে ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য নিতে গত রোববার থেকে একাধিকবার চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তথ্য ও পরিসংখ্যান উল্লেখ করে নির্বাহী চেয়ারম্যান ও তার কার্যালয় বরাবর গতকাল লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য জানতে এরপর যোগাযোগ করা হয় প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগের বিষয়গুলো অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। এটা একটা সার্কুলার (বৃত্তাকার) ব্যাপার। অবজেকটিভলি দেখলে দেখা যাবে বাংলাদেশে বিদেশী ও দেশী বিনিয়োগের হার সবসময়ই কম ছিল। বিনিয়োগের এ পরিস্থিতি নতুন নয়। আর বিনিয়োগের বিষয়গুলো সবসময় চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। আগের সঙ্গে বর্তমান বিনিয়োগের তুলনা এখন ন্যায্য কিনা সে প্রশ্ন রয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বিনিয়োগকারীরা অনেক ধরনের বিষয় চিন্তা করেন। বিনিয়োগ হঠাৎ করে বাড়ে না। অতিসম্প্রতি একটা বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে কিছু প্রতিশ্রুতি এসেছে, যেগুলো বাস্তবায়নে সময় লাগবে। এখন নানা ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। কয়েক দিনের জন্য একটা যুদ্ধও হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের একটা ইস্যু রয়ে গেছে। সার্বিকভাবে একটা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে সম্প্রতি সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরপর পরিস্থিতি কী হয় তা দেখার জন্য সময় দিতে হবে।’

গত ১২ সেপ্টেম্বর বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার চারদিন পর চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন সাক্ষাৎ করেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রতিনিধিদের সঙ্গে। সাক্ষাতে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান যেসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা আমরা দ্রুতই সমাধান করতে পারব।’

গত ৩০ অক্টোবর বিডার ‘স্টেট অব ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট’ শীর্ষক ওয়েবিনার উদ্বোধন করেন চৌধুরী আশিক। ওই আয়োজনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি ব্যবসার ন্যায্য ও স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেন। বক্তব্য প্রদানকালে একটি রোডম্যাপও উপস্থাপন করেন আশিক। তিনি বলেন, ‘রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য হলো ব্যবসা পরিচালনার সহজতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।’

নির্ভরযোগ্য ও সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে এমন সম্ভাবনাময় দেশ, প্রতিযোগিতামূলক খাত ও কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের চিহ্নিত করে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ১৮ নভেম্বর এফডিআই হিটম্যাপ তৈরির পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে বিডা। ওই ঘোষণায় নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘এতদিন আমাদের বিনিয়োগ প্রচারে সক্রিয়তার অভাব ছিল। এখন আমরা বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তথ্যভিত্তিক কৌশলগত প্রচার করতে চাই। এজন্য বিভিন্ন দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এফডিআই হিটম্যাপ তৈরির কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।’

এ বছরের ১৯ জানুয়ারি এফডিআই হিটম্যাপ প্রকাশ করে বিডা। প্রকাশকালে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘এফডিআই হিটম্যাপ শুধু একটি পরিকল্পনা নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ প্রচেষ্টার জন্য একটি রূপরেখা। আমরা যেকোনো রোড শো, দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি বা নীতিগত সহায়তা এ তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ অনুযায়ী পরিচালনা করব।’ ২৩ মার্চ বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দেন আশিক চৌধুরী। এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে অংশ নেন ৫০টি দেশের ৪১৫ প্রতিনিধি। সম্মেলন শেষে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে বলে জানান আশিক চৌধুরী।

বিনিয়োগ সম্মেলনে আসা অতিথিদের সামনে দেয়া আশিকের সাবলীল উপস্থাপনা নজর কাড়ে অনেকের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে তার এ উপস্থাপনার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। বিনিয়োগ সম্মেলনের শেষ দিকে অনেক গণমাধ্যমে বলা হয় ‘আশিক ম্যাজিকে’ বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের প্রত্যাশা। তবে বিনিয়োগের সরকারি পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতামত, প্রকৃত বিনিয়োগে ‘আশিক ম্যাজিকে’র প্রতিফলন এখনো দৃশ্যমান হতে শুরু করেনি।

স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, দেশে অবস্থানরত বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনায়ও বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে না। এক স্থানীয় বিনিয়োগকারী গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়ে এক রাষ্ট্রদূতের কাছে অভিমত জানতে চান। তার প্রশ্ন ছিল, ‘শেষ হওয়া বিনিয়োগ সম্মেলনে আপনার দেশ থেকে অনেক বিনিয়োগকারী অংশ নিয়েছিলেন, বিনিয়োগ বাস্তবায়নে তারা কত সময় নিতে পারেন?’ জবাবে সেই রাষ্ট্রদূত প্রথমেই বলেছেন, ‘রাজনৈতিক সরকার ছাড়া কোনো বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে আসবে না।’ বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি জানিয়ে সেই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এখনো মব হচ্ছে।’

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায় রয়েছেন। এছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণ নির্ভর করে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে তার ওপর। বাংলাদেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, এ পরিস্থিতিতে বিদেশীরা কীভাবে বিনিয়োগ করবেন?’

বিসিআই সভাপতি আরো বলেন, ‘দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন ১৫ শতাংশের বেশি। এত সুদ দিয়ে এখানে বিনিয়োগ করবে কে? উচ্চ সুদ ছাড়াও আমাদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ব্যয়ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা না হয় বাদই দিলাম! এ অবস্থায় বিদেশীরা এখানে কেন বিনিয়োগ করতে আসবেন? বিদেশীরা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেন না। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র থেকে ঋণ নেন। বিদেশীরা তখনই বিনিয়োগ করেন যখন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এখন নানা কারণে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। আমরা যদি না করি তাহলে বিদেশীরাও আগ্রহী হবেন না।’

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিডার বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যানের বয়স কম। তিনি গতিশীল, আন্তর্জাতিক কিছু অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। এসব কিছু বিবেচনায় আমরা আশাবাদী হতে চাই। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সামগ্রিকভাবে তার একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব না। এটা সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা। আর শুধু বিডা বা বেজা না, অন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা থাকতে হবে। বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যানের উদ্যোগগুলো হয়তো প্রশংসনীয়, কিন্তু এগুলো বাস্তবে রূপ দিতে সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকা দরকার, যা মাঠ পর্যায় পর্যন্ত বাস্তবায়ন হতে হবে। এজন্য অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। একটা বড় বিনিয়োগ যদি আমাদের থাকত তাহলে সরকারের এত উদ্যোগেরও প্রয়োজন হতো না। ওই এক বিনিয়োগকারীর ভালো অভিজ্ঞতা আরো অনেক বিনিয়োগকারীকে টেনে নিয়ে আসত। কিন্তু আমাদের অতীতে এমন রেকর্ড নেই, ফলে অসাধারণ ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা দরকার।’

বর্তমানে যে উদ্যোগগুলো নেয়া হচ্ছে সেগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে হবে উল্লেখ করে সেলিম রায়হান বলেন, ‘এখনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রচুর। এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো নামে বিনিয়োগকারীদের সেবাদাতা, কিন্তু কাজে তাদের সেভাবে দেখা যায় না। কর খাত নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের করনীতি অনুমানযোগ্য না, যা বিনিয়োগের জন্য আদৌ সহায়ক নয়। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নিজ নিজ গন্তব্যে অর্থ পাঠানো নিয়েও জটিলতার মুখোমুখি হন। এসব জটিলতায় পুরনোরাই বিনিয়োগ করছেন, নতুন কোনো বিনিয়োগ আসছে না। লজিস্টিকসসহ বিনিয়োগ অবকাঠামোর সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। বাংলাদেশের যখন এত সমস্যা তখন বিনিয়োগকারীর হাতে অনেক বিকল্প আছে, তারা ভিয়েতনামে যেতে পারেন, কম্বোডিয়ায় যেতে পারেন, এমনকি ইন্দোনেশিয়ায়ও যেতে পারেন। বাংলাদেশে কেন আসবেন? এখানে আসতে হলে সবদিক থেকে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় হতে হবে। আর এসব কিছুর ওপরে আছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা।’

বাংলাদেশের বিদ্যমান বিনিয়োগ বাস্তবতার নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে ‘ম্যাজিক’ দেখিয়ে চলেছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান, যার সর্বশেষ নিদর্শন দেখা গেছে ৮ মে। ওইদিন চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া চর পরিদর্শন শেষে আশিক চৌধুরী বড় বিনিয়োগের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি জানান, ডেনমার্কভিত্তিক শিপিং ও লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান এপি মোলার মায়ের্স্কের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার এ নির্বাহী চেয়ারম্যানকে মায়ের্স্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিষ্ঠানটি ৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশিক চৌধুরী বিনিয়োগ আকর্ষণের কাজ শুরু করেছেন, কিন্তু বাস্তবে আকৃষ্ট হওয়ার প্রতিফলন দেখাটা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এখনো সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায়। আর বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিরা বলছেন, একটি টেকসই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত তারা বিনিয়োগ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখছেন।

বিনিয়োগ আগ্রহ নিয়েও আশাব্যঞ্জক কোনো বার্তা নেই। প্রতি প্রান্তিকে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ প্রকল্প নিবন্ধনের তথ্য ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করত বিডা, যা পাওয়া যেত বিডার ওয়েবসাইটে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিবন্ধনের হালনাগাদ তথ্য ছিল ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকের। হালনাগাদ নিবন্ধন পরিসংখ্যান জানতে চাইলে বিডার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশী-বিদেশী মিলিয়ে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রকল্প সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১১৩। এসব প্রকল্পে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮৯ হাজার ১২৭ কোটি ২২ লাখ ২৩ হাজার টাকা।

চলতি অর্থবছরের ১০ মাস জুলাই থেকে এপ্রিলে দেশী-বিদেশী নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রকল্পের সংখ্যা ৮১৪। এসব প্রকল্পে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ২৭ হাজার ৯৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকলেও গত অর্থবছরের চেয়ে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রকল্প পরিস্থিতিও নেতিবাচক।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আখতার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নতুন নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়তো চেষ্টা করছেন, কিন্তু সামষ্টিকভাবে রাষ্ট্র সেই চেষ্টা করছে কিনা সেটা দেখতে হবে। একজন মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু আমরা দেখছি রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলাজনিত দুর্বলতা কাটেনি। স্থিতিশীলতা নেই। স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগকারীর আস্থা অর্জনে সমস্যা হওয়ার কথা। সব বিনিয়োগকারী এখন ভাবছেন এ সরকার কতদিন থাকবে, নতুন সরকার কবে আসবে। নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়গুলো অবধারিতভাবেই ভাবছেন। সব মিলিয়েই বিনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো শ্লথ হয়ে পড়ছে। তবে আশিক চৌধুরী চেষ্টা করছেন। আবার এটাও ঠিক যে আমরা সেই চেষ্টার প্রতিফলন কাগজ-কলমে দেখছি না। প্রতিফলন পেতে সময় লাগবে। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।’

জাভেদ আখতার আরো বলেন, ‘আমাদের বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ অনেক দিনের। এটা রাতারাতি ঠিক হবে না, অনেক সময় লাগবে। কাউকে এ কাজটা শুরু করতে হবে। আগে যারা নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তাদের অনেকেরই ব্যবসা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। এখন যিনি দায়িত্বে রয়েছেন তিনি চেষ্টা করছেন। এখন পর্যন্ত সেই চেষ্টার প্রতিফলন হিসেবে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি আমরা দেখছি না। আর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ অবকাঠামো দুর্বলতার কারণেই তাৎক্ষণিকভাবে সে রকম দৃশ্যমান কিছু পাওয়ার কথাও নয়।’

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে তিনি (আশিক চৌধুরী) চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আবার এটাও ঠিক যে এত তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যাবে না, সময় লাগবে। স্থানীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থায়ন একটা বড় সমস্যা। এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো বিনিয়োগ আকর্ষণের কাঠামোটা তৈরি করা। এতে সময় লাগবেই। যেমন বিডার বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান লজিস্টিককে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এটা ইতিবাচক কিন্তু এটা অনেক আগে থেকেই দরকার ছিল। বিনিয়োগের জন্য যে সামগ্রিক সমন্বয় ও সক্ষমতার প্রয়োগ দরকার, সেটা এতদিন হচ্ছিল না, যা মাত্র শুরু হয়েছে। এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারলে হয়তো বিনিয়োগ আসবে। নতুন নির্বাহী চেয়ারম্যান আসার পর তিন-চার মাস লেগেছে সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝতে। প্রথমে তিনি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন। এখন সেগুলো অ্যাড্রেস করা শুরু করেছেন। এগুলো ঠিকমতো অ্যাড্রেস করতে পারলে হয়তো ছয় মাস পর আমরা ইতিবাচক কিছু পাব।’

অর্থনীতির বিশ্লেষকরাও প্রায় একই ধরনের কথা বলছেন। তাদের মতে, বিদেশী বিনিয়োগ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এত বছরেও যখন সাফল্য দেখাতে পারেনি, খুব দ্রুত বা রাতারাতি পরিবর্তন আশা করাটা ঠিক না। আরো বেশকিছু কাজ আছে যেগুলো করা দরকার। দেশী বিনিয়োগ যে কারণে আটকে আছে একই কারণ বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বর্তমানে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে—যেমন এ সরকার কতদিন থাকবে অথবা আগামী নির্বাচন কবে হবে, একটা নির্বাচিত সরকার কবে আসবে। এখন যে সংস্কার কর্মসূচিগুলো নেয়া হচ্ছে, পরবর্তী সরকার সেগুলো রক্ষা করবে কিনা। নীতির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হবে কিনা। সবকিছু মিলিয়ে যখনই কোনো অনিশ্চিত অবস্থা থাকে তখন যত উদ্যোগই নেয়া হোক বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। দেশী বিনিয়োগকারীর চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে বিদেশীদের। ফলে তাদের লগ্নি করা বিনিয়োগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান বিদেশীরা। দেশী ও বিদেশী দুই ধরনের বিনিয়োগের পরিস্থিতিই এখন নাজুক।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১০

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১১

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

১২

জনগণ আসলে কী চায়

১৩

শহীদ বুদ্ধিজীবী / সুধীর চন্দ্র মজুমদার

১৪

শহীদ বুদ্ধিজীবী / মহসিন আলী

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আবুল বাশার মহিউদ্দিন আহম্মদ

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / ফাদার লুকাশ মারান্ডি

১৭

বুরুঙ্গা গণহত্যা: ৯৪ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা

১৮

২৬ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল দিন

১৯

২৫ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী

২০