ড. মুহাম্মদ ইউনুস নোবেল বিজয়ী সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তবে, বাংলাদেশে তার প্রতিষ্ঠান ও ঘনিষ্ঠজনদের নানা সুবিধা প্রাপ্তি নিয়ে বিতর্ক চলছে। সরকারি নীতিমালা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে বেশ কিছু ঘটনা আলোচনায় এসেছে। নিচে প্রতিটি বিষয়কে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হলো-
১. গ্রামীণ টেলিকমের পিএসপি লাইসেন্স: অন্যান্য অপারেটরদের তুলনায় বিশেষ সুবিধা?
বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের জন্য পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) লাইসেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ টেলিকম সম্প্রতি এই লাইসেন্স পেয়েছে, কিন্তু রবি, বাংলালিংক, টেলিটক ও অন্যান্য বড় টেলিকম অপারেটরদের আবেদন দীর্ঘদিন ধরে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিতর্কের কারণ
অগ্রাধিকারপ্রাপ্তি: কেন শুধু গ্রামীণ টেলিকমের আবেদন দ্রুত অনুমোদিত হলো, অন্যদের নয়?
নীতিগত স্বচ্ছতার অভাব: বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিটিআরসি সাধারণত লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমিক নিয়ম অনুসরণ করে। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকমের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া এড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যবসায়িক স্বার্থ: গ্রামীণ টেলিকমের মাধ্যমে গ্রামীণ ফোনের গ্রাহকদের জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট সুবিধা প্রসারিত হতে পারে, যা বাজারে একচেটিয়া প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রশ্ন
যদি সব প্রতিষ্ঠানের আবেদন একই মানদণ্ডে যাচাই করা হতো, তাহলে কেন শুধু গ্রামীণ টেলিকম লাইসেন্স পেল?
এই সিদ্ধান্তে কি কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব কাজ করেছে?
২. জনশক্তি রপ্তানিতে গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসের একচেটিয়া লাইসেন্স
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় (২০০৭-২০০৮) গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসকে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর একমাত্র লাইসেন্স দেওয়া হয়। এটি ছিল একটি অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত, কারণ সাধারণত একাধিক প্রতিষ্ঠানকে এই ধরনের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
বিতর্কের কারণ
একচেটিয়া সুবিধা: অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে তখন লাইসেন্স দেওয়া হয়নি, যা বাজারকে অসম প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যায়।
অস্পষ্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া: কীভাবে শুধু গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসকে এই সুবিধা দেওয়া হলো, তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
লাভ-লোকসানের হিসাব: এই লাইসেন্সের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি কত টাকা আয় করেছে এবং তা কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্বচ্ছ তথ্য নেই।
প্রশ্ন
এই লাইসেন্স দেওয়ার পেছনে কি ড. ইউনুসের প্রভাব কাজ করেছে?
কেন পরবর্তীতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদন আটকে রাখা হলো?
৩. গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি অনুমোদন: বোর্ডে ইউনুস পরিবার ও ঘনিষ্ঠরা
গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার বোর্ড অব ট্রাস্টিজে ড. ইউনুসের ছোট ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম এবং ইউনুস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদ রয়েছেন।
বিতর্কের কারণ
পরিবারতন্ত্র: একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বোর্ডে ইউনুসের আত্মীয় ও সহযোগীদের উপস্থিতি নৈতিক সংঘাত তৈরি করে।
সরকারি-বেসরকারি দ্বন্দ্ব: লামিয়া মোরশেদ একই সাথে সরকারের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী, যা স্বার্থের সংঘাত তৈরি করতে পারে।
শিক্ষানীতিতে পক্ষপাত: এই বোর্ড কি শুধু গ্রামীণ-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেবে?
প্রশ্ন
একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটির বোর্ডে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে নিয়োগ কতটা নৈতিক?
সরকারি ও বেসরকারি পদে একই ব্যক্তির অবস্থান কি সুশাসনের পরিপন্থী?
৪. ইউনুসের ঘনিষ্ঠদের সরকারি উচ্চপদে নিয়োগ
ড. ইউনুসের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন, যা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত দেয়।
উল্লেখযোগ্য নিয়োগসমূহ
নূরজাহান বেগম (গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক) → স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা
লামিয়া মোরশেদ (ইউনুস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক) → প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী (সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা)
অপূর্ব জাহাঙ্গীর (ইউনুসের ভাইপো) → উপপ্রেস সচিব (গণমাধ্যমে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই)
বিতর্কের কারণ
যোগ্যতা নাকি সম্পর্ক? অপূর্ব জাহাঙ্গীরের মতো ব্যক্তিরা কীভাবে উচ্চপদে নিয়োগ পেলেন?
সরকারে ইউনুস নেটওয়ার্কের প্রভাব: এই নিয়োগগুলো কি দেখায় যে ইউনুসের ঘনিষ্ঠরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করছে?
প্রশ্ন
এই নিয়োগগুলো কি শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে নাকি ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের ভিত্তিতে হয়েছে?
রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি কি সুশাসনের জন্য হুমকি?
৫. গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা হ্রাস: কাদের স্বার্থে?
গ্রামীণ ব্যাংকের ২৫% সরকারি শেয়ার কমিয়ে ১০% করা হয়েছে। এটি একটি বড় আর্থিক সিদ্ধান্ত, যা ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি খাতে নিয়ে যেতে পারে।
বিতর্কের কারণ
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস: সরকারি শেয়ার কমে যাওয়ায় ব্যাংকটির নীতিনির্ধারণে বেসরকারি স্বার্থ প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনৈতিক ঝুঁকি: গ্রামীণ ব্যাংক যদি কোনো সংকটে পড়ে, সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ কমে যাবে।
গোপনীয়তা: এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো এবং কারা লাভবান হলো, তা অস্পষ্ট।
প্রশ্ন
সরকারি শেয়ার হ্রাসের পেছনে কি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালকদের চাপ কাজ করেছে?
এই সিদ্ধান্ত কি সাধারণ জনগণের আস্থার সাথে সাংঘর্ষিক?
৬. গ্রামীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ৬৬৬ কোটি টাকা মওকুফ: কেন?
গ্রামীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বিপুল অঙ্কের ঋণ মওকুফ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
বিতর্কের কারণ
অস্বচ্ছ সিদ্ধান্ত: কোন প্রক্রিয়ায় এই ঋণ মওকুফ দেওয়া হলো, তা জানানো হয়নি।
জনগণের অর্থের অপচয়: এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তাহলে কেন রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেওয়া হলো?
দ্বৈত নীতিমালা: অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ মওকুফ না দিয়ে শুধু গ্রামীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে এই সুবিধা দেওয়া হলো কেন?
প্রশ্ন
এই মওকুফ কি আইনানুগ ছিল, নাকি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে?
এই ট্যাক্সমুক্তির ফলে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ ক্ষতি হলো?
সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব
উপর্যুক্ত ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ড. ইউনুস ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার বিশেষ সুবিধা পেয়েছে, যা সাধারণ নিয়মের বাইরে। এইসব সিদ্ধান্তে স্বজনপ্রীতি, নীতিগত অসঙ্গতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট।
কী করা উচিত?
১. স্বচ্ছ তদন্ত: এই সমস্ত বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ২. নিয়মের সমতা: সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ৩. জবাবদিহিতা: যারা এইসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের ব্যাখ্যা দিতে হবে। ৪. জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা: রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই পক্ষপাতহীন হতে হবে।
মূল প্রশ্ন
"ড. ইউনুসের প্রতিষ্ঠান ও ঘনিষ্ঠরা কি রাষ্ট্রীয় নীতিকে প্রভাবিত করছে? নাকি এটি কেবলই সমান্তরাল ঘটনা?"
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।
মন্তব্য করুন