২১ জুন ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এদিন দেশ-বিদেশে নানা রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনা ঘটে, যা যুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দমননীতি এবং মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ—সব মিলিয়ে এই দিনটি ছিল অত্যন্ত সক্রিয়।
বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান: ছয় দফাই মুক্তির সনদ এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “আমাদের এ সংগ্রাম সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। এই ছয় দফাই আমাদের মুক্তির একমাত্র সনদ।” তাঁর এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ভিত্তিই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা।
এদিকে, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নেদারল্যান্ডস সফর করেন। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ১. ব্রিটেন-ভারত যৌথ বিবৃতি ও কূটনৈতিক তৎপরতা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলাদেশের শরণার্থী সংকট ও গণহত্যা বন্ধে আলোচনার জন্য লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম-এর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি পাকিস্তানের ওপর চাপ বৃদ্ধি ও শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য রাজনৈতিক সমাধানের তাগিদ দেন।
এদিন যুক্তরাজ্য ও ভারতের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়:
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান জরুরি।
শরণার্থীদের নিরাপদে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে।
সরদার শরণ সিং এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পাকিস্তান নিজের দোষেই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। অনেক দেশই এখন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের কথা ভাবছে।”
২. জাপানে পাকিস্তানকে সাহায্য স্থগিতের সিদ্ধান্ত টোকিওতে পাকিস্তান সাহায্যকারী কনসোর্টিয়ামের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, “যতদিন না বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে, ততদিন পাকিস্তানকে নতুন সাহায্য দেওয়া হবে না।” বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি পিটার কারগিল পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার প্রমাণ পেয়ে এই সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখেন।
৩. যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ ভারতে আসেন শরণার্থী সমস্যা পর্যবেক্ষণ করতে। তিনি বলেন, “এটি শুধু ভারতের সমস্যা নয়, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।” তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান বজায় রাখেন।
৪. জাতিসংঘে ভারতের প্রতিবাদ ভারতের শ্রমমন্ত্রী আর কে খাদিলকর রাজ্যসভায় বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান পাকিস্তানপন্থী বিবৃতি দিয়েছেন। ভারত সরকার এ নিয়ে জাতিসংঘে প্রতিবাদ জানায়।
পাকিস্তানের প্রচারণা ও দমননীতি ১. ঢাকায় পাকিস্তানি জেনারেলের আগমন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান ঢাকায় আসেন। তিনি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন, সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে নতুন কৌশল নির্ধারণের জন্য।
২. জামায়াতের নেতার বক্তব্য লাহোরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আজম বলেন, “পাকিস্তান রক্ষায় সামরিক ব্যবস্থা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। আওয়ামী লীগের আন্দোলন ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল!”
৩. ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের নেতা জিল নাইট ঢাকায় বলেন, “আমরা গণহত্যার প্রমাণ দেখিনি।” এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার সৃষ্টি করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ কুমিল্লা: মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়পুর ব্রিজে পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়ি অ্যামবুশ করে। ৮ সেনা নিহত হয়, গাড়ি দুটি ধ্বংস হয়।
নোয়াখালী-ফেনী সড়ক: বোগাদিয়া ও বজরায় দুটি পৃথক অ্যামবুশে পাকিস্তানিদের ১২ সেনা নিহত ও দুটি ট্রাক ধ্বংস হয়।
আখাউড়া-সিলেট রেলপথ: তেলিয়াপাড়ায় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে।
২১ জুন ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়। ব্রিটেন, ভারত ও জাপানের মতো দেশগুলো পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়ায়, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী দেশের ভেতরে সফল গেরিলা অপারেশন চালিয়ে যায়। এই দিনটি প্রমাণ করে যে, মুক্তিযুদ্ধ কেবল সশস্ত্র সংগ্রামই নয়, এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াইও।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান ২২ জুন ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ২২ জুন ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর ২২ জুন ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ;
ইত্তেফাক ও আজাদ, ২২ ও ২৩ জুন ১৯৭১;
আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ২২ ও ২৩ জুন ১৯৭১
মন্তব্য করুন