ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১৮ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিন ও কান্দাপাড়ার পৈশাচিক গণহত্যা

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫, ১১:৫৬ এএম
বাগেরহাটের একটি বধ্যভূমির বর্তমান অবস্থা | ছবি: প্রিয়ভূমি
বাগেরহাটের একটি বধ্যভূমির বর্তমান অবস্থা | ছবি: প্রিয়ভূমি

১৯৭১ সালের ১৮ জুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল দিন। এদিন দেশ-বিদেশে রাজনৈতিক আলোচনা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া একত্রিত হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো কণ্ঠ

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ঐতিহাসিক বক্তব্য

লন্ডনে সাংবাদিকদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার নিন্দা করে বলেন,

“যারা আমাদের শিশু ও নারীদের খুন করেছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে, নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের আমরা কখনো ক্ষমা করতে পারব না। এই গণহত্যার পর পাকিস্তানের সাথে একত্রে থাকার প্রশ্নই উঠে না। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র।”

তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর পদক্ষেপেরও দাবি জানান।

ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত মইনুল হক চৌধুরী ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর শেষে জানান,

“৬০ লাখ শরণার্থীর সমস্যা এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। পাকিস্তানকে সামরিক অভিযান বন্ধ করে রাজনৈতিক সমাধানে বাধ্য করতে হবে।”

এদিন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় ভারত সরকারের সমালোচনা করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানায়।


পাকিস্তানের প্রপাগান্ডা ও গোলাম আজমের ঘৃণ্য ভূমিকা

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজম লাহোরে এক বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের “ভারতের চর ও বিচ্ছিন্নতাবাদী” আখ্যা দিয়ে বলেন,

“জাতীয় পরিষদ না থাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না।”

অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও গভর্নর টিক্কা খান শরণার্থীদের ফিরে আসার আহ্বান জানালেও, তাদের এই আহ্বান ছিল ধোঁকাবাজি, কারণ বাংলাদেশজুড়ে তখন চলছিল গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ।

কান্দাপাড়ার নির্মম গণহত্যা

১৮ জুন, শুক্রবার বাগেরহাটের কান্দাপাড়া বাজারে রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়।

ঘটনার বিবরণ

  • দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজাকার বাহিনী দুই দলে বিভক্ত হয়ে কান্দাপাড়ায় প্রবেশ করে।

  • মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী দেলোয়ার হোসেন মাস্টারইব্রাহিম হোসেন মাস্টারের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।

  • স্থানীয় যুবক, বৃদ্ধ ও শিশুসহ ২৫ জনকে ধরে এনে ২৩ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। লাশের মাথা কেটে বুকের ওপর রেখে রাস্তায় সাজিয়ে রাখা হয়।

  • মঞ্জুর মোল্লা নামে এক ব্যক্তি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান, আরেকজনকে অত্যাচার করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এই গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের এক জঘন্য অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লেখা রয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান

কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে যুদ্ধ

  • লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সায়দাবাদ কামান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়।

  • পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধে ৬০ জন শত্রুসেনা নিহত হয়।

কৈখোলার পুনর্দখল

  • পাকিস্তানি বাহিনী কৈখোলা দখল করলে মেজর সালেক চৌধুরী রাতে পাল্টা আক্রমণ চালান।

  • দুই ঘণ্টার যুদ্ধে ৩১ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনী কৈখোলা পুনরুদ্ধার করে।

সেতু ও বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস

  • মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা-লাকসাম রেলসেতুবাগমারা সড়ক সেতু উড়িয়ে দেয়।

  • বিজয়পুর ও মিয়াবাজারে বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অন্যান্য অঞ্চলে সংঘর্ষ

  • মৌলভীবাজারে ২৫ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

  • দিনাজপুরের ঠনঠনিয়াপাড়ায় ১৫ শত্রুসেনা নিহত হয়।

ঢাকায় গেরিলা আক্রমণ: বিশ্বব্যাংক দলের সামনে বোমা বিস্ফোরণ

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল (আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, হাবিবুল আলম, মোফাজ্জল হোসেন মায়া, কামরুল হক স্বপন) ৯/১০ জুন রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলায় বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের দল সামান্য আহত হন। ঢাকার মতো সুরক্ষিত এলাকায় এই অভিযান পাকিস্তানি বাহিনীকে হতবাক করে দেয়।

সরকারি ঘোষণা ও শিল্পীদের সমর্থন

  • এএইচএম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মুজিবনগরে বলেন, "৩-৪ মাসের মধ্যে মুক্তিবাহিনী বিজয়ী হবে।"

  • কলকাতায় দুই বাংলার শিল্পীদের সমাবেশ হয়, যেখানে কামরুল হাসান সভাপতিত্ব করেন। আগস্টে বাংলাদেশের শিল্পীদের ছবি বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

  • যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি নিক্সন প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করে বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের গণহত্যাকে উপেক্ষা করছে।"

  • বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহায়তা স্থগিতের সুপারিশ করে।

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনটি প্রমাণ করে, বাঙালিরা শুধু নিষ্পেষিতই হয়নি— তারা সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কান্দাপাড়ার গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আন্তর্জাতিক সমর্থন— সব মিলিয়ে ১৮ জুন ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

সূত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সপ্তম, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ খণ্ড; ইত্তেফাক ও আজাদ, ১৯ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১৯ ও ২০ জুন ১৯৭১

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১০

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১১

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১২

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৩

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৪

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৫

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৬

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৭

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

১৮

৩০ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট

১৯

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা দেশ কখনোই সভ্য হতে পারে না

২০