ঢাকা রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

উলানিয়ার সেই কিশোর

ড. এম আব্দুল আলীম
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫, ০৪:২৭ পিএম
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলার ভেনিস বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম উলানিয়া। এ গ্রামের জমিদার-পরিবারে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন একুশের গানের অমর স্রষ্টা, সাহিত্যিক, কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। পরিবারটি তখন ক্ষয়িষ্ণু। বিত্তবৈভব তেমন না থাকলেও সামন্ত আভিজাত্যের ঠাটবাট আর চিত্তবৈভব তখনো বজায় ছিল। এ বাড়ির যৌথ পরিবারের চাঁদের হাটে গাফ্ফার চৌধুরী বেড়ে ওঠেন। গ্রামের প্রকৃতির উদার আবহে কাটে তার শৈশব। উলানিয়া গ্রামের মুয়াজ্জিন খলিল মুনশিজী তার শিশুমনে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে, পৃথিবীর নানা দেশের মসজিদের আর কোনো মুয়াজ্জিনের আজানই তার কাছে অতটা মধুক্ষরা মনে হয়নি। এই মুনশিজীর মতোই গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম মৌলভী আহমদ আলীও তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। উলানিয়া গ্রামের মৌলভী আহমদের দেওয়া মানবতা ও দেশপ্রেমের শিক্ষার পাশাপাশি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাবার কাছে পেয়েছিলেন অহিংসা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং স্বদেশি আন্দোলনের দীক্ষা।

বাবার প্রভাবেই কিশোরকালে নাম লিখিয়েছিলেন ছাত্র কংগ্রেসে, পরে বরিশালে এসে যুক্ত হন ছাত্র ফেডারেশন ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আইনসভার সদস্য চৌধুরী মোহাম্মদ আরিফ (আসাদ চৌধুরীর বাবা), স্বদেশি আন্দোলনের কর্মী আবদুল খালেক খান, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা স্বদেশ বসু, মহারাজ প্রমুখ তার কিশোরমনে গভীর প্রভাব ফেলেন। ১৯৪৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর গ্রামের মাদ্রাসার পাঠ চুকিয়ে বরিশাল শহরের আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে পড়তে গিয়ে অল্প বয়সেই ঝুঁকে পড়েন রাজনীতি ও লেখালেখির দিকে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি পড়েন কলকাতা ন্যাশনাল বুক এজেন্সির ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, মার্কসবাদের অ আ ক খ। সবচেয়ে প্রভাবিত হন নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় অনূদিত ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাস দ্বারা। লেনিন, স্ট্যালিন, টিটোর জীবনীও পড়া হয়ে যায়। সুযোগ পেলেই লাল টুপি মাথায় আর লাল ঝাণ্ডা হাতে শামিল হতেন ছাত্র ফেডারেশনের মিছিলে। স্লোগান তুলতেন, মন্দির মসজিদ এক আওয়াজ, খতম কর ব্রিটিশ রাজ, শহিদ লাখো ভাই কেয়া পুকার, ইনকিলাব জিন্দাবাদ। ওই সময় যোগ দেন পটুয়াখালীতে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনে। সেখানে গিয়ে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাক্ষাৎ লাভ করেন।

সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন অতি অল্প বয়সে। বাবার বন্ধু দুর্গামোহন সেনের হাত ধরেই সাংবাদিকতা শুরু। সেটা ১৯৪৭ সালের কথা। দুর্গামোহন সম্পাদিত কংগ্রেস হিতৈষী পত্রিকায় প্রথম সাংবাদিকতা করেন। তার পর দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, সওগাত, দিলরুবা, ইত্তেফাক, আজাদ, মোহাম্মদী, সোনার বাংলা, পূর্বদেশ, জয়বাংলা, জাগরণ প্রভৃতি পত্রিকায় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্পাদনা করেছেন নকীব, চাবুক, জনপদ, নতুন দিন প্রভৃতি পত্রিকা। কলাম লিখেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পত্রিকায়।

সাংবাদিকতার মতো সাহিত্যিক সত্তার স্ফুরণও ঘটে কৈশোরেই। যে শহরে তার বেড়ে ওঠা, সেই বরিশালে জন্ম এবং চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। ওই কলেজে আরও অধ্যাপনা করতেন লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তখন বরিশালের পটুয়াখালীর মহকুমার মুন্সেফ ছিলেন সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ডিস্টিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। কিশোর বয়সেই কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষুধা পাঠে জেনেছিলেন বরিশাল বাংলার ভেনিস। শামসুদ্দীন আবুল কালাম এবং আহসান হাবীবের লেখায় বরিশালের খাল-বিল, নদী-নালা, গ্রাম, জনপদের জীবন্ত বর্ণনা পড়ে সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে পড়েছিলেন তারাশঙ্করের কবি ও ধাত্রীদেবতা উপন্যাস। বারবার পড়েন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতসী মামী এবং নেকী গল্প। কেবল সাহিত্যপাঠ নয়, সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে বরিশাল শহরে দেখা পান তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবিরের মতো সাহিত্যিক এবং বিজয় লক্ষ্মী পণ্ডিত, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তীর মতো রাজনীতিক ও বিপ্লবীকে। এক কথায় বরিশালের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভা ও ঔজ্জ্বল্য তাকে জাগিয়ে তোলে। স্কুলজীবনেই দৈনিক আজাদ-এর মুকুলের মাহফিল এবং নবযুগ পত্রিকার আগুনের ফুলকির সদস্য হয়েছিলেন। গ্রামের মাদ্রাসায় পড়ার সময় ১৯৪৫ সালে নবযুগ-এর আগুনের ফুলকিতে প্রকাশিত হয় তার প্রথম লেখা; যেটি ছিল পান্থশালা নামের ছোট্ট নাটিকা। ১৯৪৬-৪৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার মুকুলের মাহফিলে প্রকাশিত হয় তার আষাঢ়ে নামক কবিতা এবং বার্নার্ড শ-র কলম শিরোনামের ছোটগল্প। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বরিশালের নকীব পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। এভাবেই উলানিয়ার দুরন্ত কিশোর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার গল্প প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭), ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা (১৯৯৪), পলাশী থেকে ধানমন্ডি, আমরা বাংলাদেশী না বাঙালী প্রভৃতি। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৮৩), স্বাধীনতা পুরস্কারসহ (২০০৯) নানা পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।

আটচল্লিশের ভাষা-আন্দোলনের সময় বরিশাল থেকে গ্রেপ্তার হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। তখন ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে যোগ দেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শহিদদের গায়েবানা জানাজা শেষে শোক-শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে পুলিশি নির্যাতনে মারাত্মকভাবে আহত হন। তার সবচেয়ে বড় দান একুশের গান রচনার ক্ষেত্রে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া ভাষাশহিদ রফিকউদ্দিনের রক্তাক্ত দেহ দেখে তার স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে রচনা করেছিলেন একুশের অমর সংগীত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, যেটি স্বীকৃতি পেয়েছে প্রভাতফেরির অমর সংগীত হিসেবে। বাংলা ভাষাভাষী তো বটেই, অন্য ভাষার মানুষের কাছেও গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

জীবনের শেষ ছয়চল্লিশ বছর দূর প্রবাসে লন্ডনে বসবাস করলেও তার চিত্তের বীণায় সর্বদা বেজে উঠত উলানিয়ার সুর। কখনোই তিনি উলানিয়া তথা শেকড়ের টান ভুলতে পারেননি। ২০২২ সালের ১৯ মে তার কলম চিরতরে থেমে যায়। উলানিয়ার সেই কিশোর, পরবর্তীকালের কীর্তিমান লেখক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১০

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১১

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

১২

জনগণ আসলে কী চায়

১৩

শহীদ বুদ্ধিজীবী / সুধীর চন্দ্র মজুমদার

১৪

শহীদ বুদ্ধিজীবী / মহসিন আলী

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / আবুল বাশার মহিউদ্দিন আহম্মদ

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / ফাদার লুকাশ মারান্ডি

১৭

বুরুঙ্গা গণহত্যা: ৯৪ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা

১৮

২৬ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল দিন

১৯

২৫ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী

২০