১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস থাকার কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে সেনানিবাসসহ গোটা কুমিল্লায়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ কুমিল্লা শহর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে হত্যা করে সেনানিবাসে এনে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ছাড়া জেলার সর্বত্র নারকীয় তাণ্ডবের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ লোকদের গণকবর দেওয়া হয়। এসব গণকবর ও বধ্যভূমির অধিকাংশ এখনো শনাক্ত হয়নি। কিছু শনাক্ত হলেও সংরক্ষণ করা হয়নি। অবহেলা-অনাদরে অধিকাংশ বধ্যভূমির স্থান ঝোপ-জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কোথাও আবার হয়েছে গোচারণভূমি।
জেলা গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ১১০ জনের সমাধি সংরক্ষণের জন্য প্রতিটিতে দুই লাখ করে মোট ২ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এ ছাড়া ৮টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রতিটিতে ৮০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস ও মুক্তিযোদ্ধা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের পুরো এলাকাকে পাকিস্তানি বাহিনী বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। একাত্তরের ২২ মার্চ থেকে ময়নামতি সেনানিবাসে পাকিস্তানের কমান্ডো ও গোলন্দাজ বাহিনী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারদিকে পরিখা খনন করে।
২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। ২৬ মার্চ সকালে ৫৩ ব্রিগেডের গোলন্দাজ ইউনিটের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে সেনানিবাসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ৩০ মার্চ বিকেলে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক এ কে এম শামসুল হক খান ও পুলিশ সুপার মুন্সী কবীর উদ্দিনকে সেনানিবাসে গুলি করে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার পর ময়নামতি এলাকার ঝোপঝাড়, ছোট ছোট টিলা, সমতল ভূমির কাশবনে, ডোবা বা নালার পাশে পাওয়া গেছে অসংখ্য নরকঙ্কাল।
রাজনীতিবিদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অমানুষিক নির্যাতনের পর ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। এ ক্যান্টনমেন্টে মোট ১২টি গণসমাধি খনন করে এরই মধ্যে সাত হাজারেরও বেশি মানুষকে গণকবর দেওয়া হয়। এ ছাড়া সেনানিবাসের ভেতর রয়েছে আরও অনেক গণকবর।
রসুলপুর বধ্যভূমি:
কুমিল্লা সদরের রসুলপুর বধ্যভূমিতে পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষকে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
মুদাফফরগঞ্জ বধ্যভূমি:
মুদাফফরগঞ্জ বধ্যভূমিতে ৩৭ জন লোককে গণকবর দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে অবস্থিত চান্দিনার হাড়ং বধ্যভূমিতে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গণকবর দেওয়া হয়।
আমড়াতলী বধ্যভূমি:
কুমিল্লার আমড়াতলী বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খন্দকার বাড়ির ২৬ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যার পর গণকবর দেয়। কুমিল্লা সদর দক্ষিণের জগতপুর বধ্যভূমি অবস্থিত। সেখানে ২৫ জনের গণকবর দেওয়া হয়।
রামমালা বধ্যভূমি:
নগরীর রামমালা এলাকায় সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতরে পুকুর পাড়ে রয়েছে রামমালা বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ চালালে ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ার করে সেখানে অবস্থানরতদের হত্যা করে। পরে গর্ত করে গণকবর দেয় হানাদার বাহিনী। স্থানীয় সূত্র মতে, এ বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫০০ লোকের সমাধি।
কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি:
সদরের পাঁচথুবী ইউনিয়নে কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় এলাকায় কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকের এক দুপুরে এ এলাকায় বসবাসরত শিশু-নারী, কৃষকসহ ৩৭ জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে ব্রাশফায়ার করে নির্বিচারে হত্যা করে ঘাতক হানাদাররা। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালের ১৬ জুন জায়গাটি চিহ্নিত করে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদ হাছান।
লাকসাম বেলতলী বধ্যভূমি:
৭১-এর যুদ্ধকালীন কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে দক্ষিণে বেলতলীর এই বধ্যভূমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর মরদেহ মাটিচাপা দিয়েছিল হানাদার বাহিনী।
পাক সেনাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের নীরব সাক্ষী লাকসাম রেলওয়ে জংশন কলোনির শ্রীধাম চন্দ্র দাশ তার মামা সুরেন্দ্র দাস ও উপেন্দ্র দাস জানান, পাকিস্তানি বাহিনী ওই সময় সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে নারী-পুরুষের হাজার হাজার মরদেহ নিয়ে বধ্যভূমিতে গর্ত করে মাটিচাপা দিয়েছে।
দাউদকান্দি বধ্যভূমি:
১৯৭১ সালের ২৩ মে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী রায়পুরা গ্রামের ১১ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এখানে গণগবর দেয়।
কুমিল্লা সেনানিবাসের এমআর চৌধুরী গ্রাউন্ডের পাশের বধ্যভূমি, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, সেনা সদস্য, সেনানিবাসে অবস্থানরত বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং কুমিল্লা শহর থেকে ধরে নেওয়া ব্যক্তিবর্গসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক লোককে সেনানিবাসে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে এ বধ্যভূমিটি সংস্কার করে সেনানিবাস কর্তৃপক্ষ।
দেবিদ্বার বধ্যভূমি:
দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাকবাংলোর সামনে অবস্থিত বধ্যভূমিটি পাক হায়নাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই পাক হায়নারা মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামে ১৪২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে অনেক নারীও নির্যাতনের শিকার হন। পরে আরও ১৯ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে গর্ত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
বরুড়া বধ্যভূমি:
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার পয়ালগাছা ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের বটতলীতে যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। গ্রামে প্রবেশ করে ছয়জন নিরীহ লোককে হত্যা করে। বটতলীর ভয়াবহ যুদ্ধ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর রাজাকারসহ শত শত হানাদারের বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পয়ালগাছার বটতলীতে এক সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে দিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। অবশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনী কিছুক্ষণের মধ্যে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। সে দিনের বটতলীর ভয়াবহ যুদ্ধে শাহাদতবরণকারী পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে নারায়ণপুরের মাটিতে সমাধি করা হয়।
নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি:
নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমিতে নোয়াখালী, নাঙ্গলকোট ও আশপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে তিনটি কবরে গণসমাহিত করে পাক হানাদার বাহিনী।
চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা বধ্যভূমি:
১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা নামক স্থানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীর যোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। বেতিয়ারার শহীদদের কবরটি এখন আগের স্থানে নেই। বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শফিউল আহমেদ বাবুল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কুমিল্লায় অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টির মতো বধ্যভূমি শনাক্ত করা হয়েছে। আরও অনেক বধ্যভূমি রয়েছে। এগুলো শনাক্ত ও উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। সরকার অর্থও বরাদ্দ দিয়েছে।’
মন্তব্য করুন