মামলার বোঝায় ভারী হয়ে উঠেছে খুলনার আদালত। খুলনার বিভিন্ন আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৯৮ হাজার।
বাদী, বিবাদী, কৌঁসুলিসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফৌজদারি মামলায় অনেক প্রতিবেদন দেরিতে আসা, আসামিপক্ষের বারবার সময়ের আবেদন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, সাক্ষীদের সঠিক সময়ে হাজির করতে না পারাসহ নানান কারণে নিষ্পত্তি হচ্ছে না এসব মামলার।
অপরদিকে দেওয়ানি মামলায় সমন জারি ও গ্রহণে বিলম্ব, বারবার সময় চেয়ে আবেদন, ভূমি পরিমাপে কমিশন নিয়োগে দেরি, আর্জি সংশোধন, বারবার আপত্তি দিয়ে সময়ক্ষেপণের কারণে ঝুলে থাকছে মামলাগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা দায়রা আদালত, মহানগর দায়রা আদালত, নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালসহ খুলনার বিভিন্ন আদালতে প্রায় ৯৮ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যার মধ্যে জেলা জজ আদালতে সিভিল মামলা ৫১ হাজার ৬৬টি ও ক্রিমিনাল মামলা ৪ হাজার ২৮২টি, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রায় ১৩ হাজার মামলা এবং বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে প্রায় ১৫ হাজার মামলাসহ বিভিন্ন আদালতে প্রায় ১৪ হাজার মামলা চলমান রয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, বাদী-বিবাদী সব পক্ষের আন্তরিক সহযোগিতাই পারে মামলার জট কমাতে। সাক্ষী হাজির নিয়ে অনেক সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এক্ষেত্রে বিচারকাজে বিলম্ব হলে মামলাজট তৈরি হয়।
দেওয়ানি মামলার বিচারপ্রার্থী আব্দুল হালিম জানান, প্রায় তিন বছর যাবত দেওয়ানি মামলা চলমান রয়েছে। অনেক সময় আদালতে নির্ধারিত তারিখে এসে শুনতে হয়েছে কোর্ট উঠবে না। আবার অনেক সময় অন্য পক্ষ হাজির হন না। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় অর্থ ও সময় নষ্ট হচ্ছে।
ফৌজদারি মামলায় বিচার প্রার্থী সুজন হোসেন জানান, পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট পেয়ে অভিযোগ গঠন হতেই দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে সময় নিয়ে এখন নিজের কাছেই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ডুমুরিয়া থেকে আসা বিচারপ্রার্থী রবিউল হক বলেন, জমির মালিকানা নিয়ে মামলা দায়ের করেছি প্রায় সাত বছর আগে। তারিখের পর তারিখ পড়েছে। মামলা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে সাত বছরে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। যাতায়াতে খরচ অনেক গেছে। এখন সঠিক রায় পেলেই সন্তুষ্ট আমি।
আইনজীবী মুরাদ হোসেন বলেন, বিচারপ্রার্থীরা সঠিক বিচার পাওয়ার আশায় বিজ্ঞ আদালতে আসেন। ক্রিমিনাল মামলায় অনেক জটিলতা থাকে। পুলিশি তদন্ত থাকে। সাক্ষীর বিষয় থাকে। পুলিশের তদন্ত রিপোর্টের জন্য অনেক কালক্ষেপণ হয়। কিন্তু রিপোর্টের পর মামলা ট্রায়ালে গেলে সাক্ষীর হাজির হওয়া নিয়ে অনেক সময় বেগ পেতে হয়। এজন্য কার্যতালিকায় প্রতিদিন মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
আইনজীবী মো. মিলন বলেন, অপ্রয়োজনীয় মামলা, সঠিক সময়ে সাক্ষীদের উপস্থিত না হওয়া, মামলা হাইকোর্টে পেন্ডিং থাকা, বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের অদক্ষতার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সূত্রিতায় বিচারপ্রার্থীরা প্রতিদিনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
খুলনা সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান বলেন, অপ্রয়োজনীয় মামলার কারণে আদালতে মামলার চাপ বাড়ে। যার কারণে বিচারকাজেও অনেক সময় কাল বিলম্ব হয়। অনেকে না বুঝেই এক আদালতের মামলা অন্য আদালতে দায়ের করেন। যার জন্য জটিলতাও তৈরি হয়।
তিনি আরও বলেন, সিভিল মামলা নিষ্পত্তির হার বেশি। কিন্তু ক্রিমিনাল মামলা নিষ্পত্তির হার কম। কারণ ক্রিমিনাল মামলায় কোর্টে সাক্ষী সময়মতো আসেন না, আবার অনেক সময় সাক্ষী রিকল দিয়েও পাওয়া যায় না।
খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সচিব শেখ নুরুল হাসান রুবা বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য পুরাতন বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রয়োজন, বিনা কারণে কোনো মামলা মূলতবির ক্ষেত্রেও আইনের সংস্কার প্রয়োজন। এছাড়াও সুপারভিশনের অভাবে অনেক মামলা দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন থাকে। একটা মামলা বিচার বিভাগের অধীনে প্রসেস হতে অনেক সময় লাগে। বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের দক্ষতার অভাবে এই সময় দীর্ঘায়িত হয়।
তিনি আরও বলেন, আইনি জটিলতা দূর করলে এবং সকলের আন্তরিকতা থাকলে সাধারণ বিচার প্রার্থীরা উপকৃত হবেন এবং তাদের অর্থ ও সময় দুইই বাঁচবে।
মন্তব্য করুন