‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।
মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই।।’
দাদরা তালে ১৯১০ সালে এই গানটি লিখেছিলেন কবিগুরু। এই গানের সারমর্ম হলো, ‘যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া’ যখন মন ও মননে লাগে, তখনকার পরিস্থিতির বয়ান। এই দুই লাইন মানবজীবনের অনেক অনেক কঠিন কঠিন দর্শনের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। ওসব ঢের জটিল বিষয়। এর চেয়ে বরং বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বরূপ বোঝাতে কবিগুরুর লেখা এই দুই লাইনের শরণ নেওয়া যাক।
আজ থেকে শতবছরেরও বেশি সময় আগে নিশ্চিতভাবেই বঙ্গে সংবাদমাধ্যমের অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করে এমনটা লেখেননি গুরুদেব। তিনি মানবমন নিয়েই লিখেছিলেন। তবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের দীর্ঘদিন ধরে চলা দুরবস্থা দেখলে হয়তো বলেই দিতেন যে, ‘সোনার হরিণ’–এর সংজ্ঞায়ন এ দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার রূপক হিসেবেই বেশি যুক্তিযুক্ত!
এ দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বললেও অত্যুক্তি হয় না। সেই থেকেই সংবাদমাধ্যমগুলো নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন এবং কদাপি স্বল্প সময়ের জন্য অর্জিত হয়েছে বলে ভ্রম হলে, তা ধরে রাখা নিয়ে সদা সংগ্রাম করে চলেছে। এ দেশে কতবার শাসক পরিবর্তন হয়েছে, শাসনের ধরণ পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সব কিছুর পরও একটি বিষয়ে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সেটি হলো, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকোচিত করার চেষ্টা। সব আমলেই দেখা যাবে যে, আগের আমলের চেয়ে অন্যভাবে, আরেকটু চেপে ধরার ইচ্ছা।
যে কোনো দেশেরই শাসন কাঠামো অবশ্যই স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমকে ভয় পায়। একই সঙ্গে পুঁজিবাদী কাঠামোও ভয় পায়। এই ভয়ের কারণটি মূলত নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা, শোষণ ও দুর্নীতি প্রকাশিত হওয়ার আশঙ্কায় নিহিত। এবং এই কারণেই সংবাদমাধ্যমকে দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বেশির ভাগ উন্নত দেশেই এই কাজটি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, যাতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে, কেউ বা কোনো পক্ষ (সংবাদমাধ্যমের মালিকপক্ষসহ) স্বৈরাচারী না হয়ে উঠতে পারে। এবং এসব কারণেই হয়তো আমাদের দেশে বরাবরই সংবাদমাধ্যমের স্বাতন্ত্র্য না রাখার চেষ্টা করে গেছে ক্ষমতাশালীরা। তাতে আরও বেশি করে তেল, ঘি ঢেলেছে সংবাদমাধ্যমের তথাকথিত মালিকপক্ষের সিংহভাগও। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রে তারাও একদল কিডন্যাপার বটে। এমন কিডন্যাপারদের সহযোগী হিসেবে থাকেন রাজনৈতিক ও আদর্শিক পক্ষপাতদুষ্ট একদল সাংবাদিকও। এভাবেই তৈরি হয়েছে সার্বিক ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। এবং একাধিক পক্ষের যুগপৎ এই কাজে যে বেশ সফলতাও পাওয়া গেছে, তা তো এ দেশের সংবাদমাধ্যমের বর্তমান দুরবস্থা দেখলেই বোঝা যায়।
দুরবস্থাটি কেমন? এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য–উপাত্ত দেওয়া যাক। আসলেই দুরবস্থা কিনা, তা নাহয় আপনারাও বিচার করে দেখুন।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে থাকা সংবাদমাধ্যমগুলোর অবস্থা নিয়ে প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স প্রকাশ করে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস। প্রতি বছরই এ সূচক প্রকাশিত হয়। ২০২৪ সালের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫, স্কোর ২৭.৬৪। ২০২৩ সালের বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৩, স্কোর ছিল ৩৫–এর বেশি। তবে ২০২৫ সালের সাম্প্রতিক সূচকে অবশ্য ১৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ, যদিও স্কোর ৩৩.৭১। এবারের সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম। ভারত–পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও নেপাল (৯০তম), শ্রীলঙ্কা (১৩৯তম) ও মালদ্বীপের (১০৪তম) চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ এবারও ‘বেশ গুরুতর’ বলে উল্লেখ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও এক বিবৃতিতে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলা ক্রমশ বাড়ছে। এ বিষয়ে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলেও মত প্রকাশ করেছিল তারা।
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে সাংবাদিকদের কাজের জন্য বিপজ্জনক দেশের তালিকায় নাম এসেছে বাংলাদেশের। সেই তালিকাও তৈরি করেছিল বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)।
এদিকে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দেশীয় সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতা বাড়ছেই। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এমএসএফ জানিয়েছে, দেশে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
এই প্রতিবেদনে যুক্ত সারণীতে বিগত দুই মাসের মানবাধিকার লংঘনের তুলনামূলক পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গত মাসের চেয়ে এ মাসে সাংবাদিকতার চিত্র বেশ উদ্বেগজনক। মার্চে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৩৪ জন আর নানাভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে হয়রানীর শিকার হয়েছেন ৬২ জন সাংবাদিক। দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল মাসে ২৪টি ঘটনায় ৬২ জন সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে হামলা, আইনি হয়রানি, গ্রেফতার, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মার্চ মাসে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ছিল ১টি, তা এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারে।’
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) আরও বলেছে, ‘চলতি ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের যেভাবে শারীরিক, মানসিক এবং আইনি হয়রানি, আক্রমণ, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হয়েছে—তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দায়ের স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য হুমকি। পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এভাবে অব্যাহতভাবে মামলা দায়ের চলতে থাকলে এ পেশা থেকে কখনোই ভয়ের সংস্কৃতি দূর করা যাবে না।’
এখন চাইলে গত আরও কয়েক মাসের অথবা আরও কয়েক বছরের অথবা আরও কয়েক দশকের এ সংক্রান্ত হিসাবও খোঁজা যায়। সেসব দেখতে দেখতে বোঝা যাবে যে, কীভাবে দিনকে দিন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকোচিত করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে এবং সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন–নিপীড়ন চালানো হয়েছে। নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানোই হয় কাউকে বা কোনো পক্ষকে দাবিয়ে রাখার জন্য। তাই এ দেশে সাংবাদিকদের উপরও এসব চলে ভয় দেখানোর জন্যই, যেন বেশি ‘বাড়’ না বাড়ে। এই বাড়াবাড়ি বলতে ক্ষমতা আসলে কী বোঝে, তা নিশ্চয়ই আর খোলাসা করে বলতে হবে না।
আশা করা যায়, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ‘দুরবস্থা’র প্রকার কিছুটা বোঝা গেছে। এমন দেশে যখন ৩ মে ‘প্রেস ফ্রিডম ডে’ পালিত হয়, তখন সাংবাদিক হিসেবে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও ঝোলাতে হয়। হাজার হোক, সাংবাদিকদের বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্যই তো এই দিবস। কিন্তু বারবারই মনের কোণে একটি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি উঁকি দেয় এই বলে যে, ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আসলে কোথায়?’ হয়তো সুবোধের মতোই পালিয়ে গেছে!
আমাদের দেশে আসলেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকলে আরএসএফ–এর ইনডেক্সে বাংলাদেশ নামটি এত নিচে থাকত না। এমএসএফ–এর প্রতিবেদনেও নির্যাতিত সাংবাদিকের সংখ্যা এক মাসের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হতো না। যদিও কোনো সরকারই নিজেদের আমলের কোনো অবনমনই স্বীকার করে না। এর আগের সরকারের আমলেও তা অনুপস্থিত ছিল, তার আগেও ছিল, এমনকি তার আগেও। এবারের ভাবগতিকও সুবিধার নয়। আর গা–জোয়ারি কথাতেই যখন সব চলে, তখন আর এত ভাবনা–চিন্তার দরকারই বা কী!
যাক গে, আর বেশি কথার দরকার নেই। প্রবাদেই তো আছে, ‘বোবার শত্রু নাই’। আর বেশি কথাতেই যত জ্বালা। পরে দেখা গেল মুখ ফসকে কি না কি বলা হয়ে গেল, ওদিকে সবাই তখন সমস্বরে বলে উঠবে—‘…চাকরি থাকবে নাআআআ!’
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
মন্তব্য করুন