মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বহু ঘটনাপ্রবাহ জড়িত ছিল। নিচে ১৯৭১ সালের এই দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবাদ
পাকিস্তানের অব্যাহত মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদে ১৮ মে বাংলাদেশ সরকার একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করে। সরকারের তথ্য বিভাগের বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ব্যাপক জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দমনের অজুহাত দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই মিথ্যা প্রচারণার ভিত্তিতে কিছু বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা জানায়।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ২৬ মার্চ থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মিথ্যা প্রচার বিশ্ববাসী গ্রহণ করেনি। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হামলায় বাংলাদেশে অন্তত ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এবং ৩০ লাখ মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় গিয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা কখনও বলেননি যে বাঙালিরা জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে। বরং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী অবাঙালিরা যেখানেই গেছে, সেখানেই বাঙালিদের হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো বর্বরোচিত কাজে লিপ্ত হয়েছে।
আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ সরকার জানায়, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের গণহত্যার দায় ঢাকতে বিদেশে প্রচার করছে যে বাংলাদেশে অবাঙালি মুসলিমদের হত্যা করা হয়েছে বলেই সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ২৬ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানকারী ৪০ জন বিদেশি সাংবাদিক এমন কোনো ঘটনার সাক্ষ্য দেননি।
বৌদ্ধ নেতাদের আবেদন
পাকিস্তান বৌদ্ধ পরিষদের সভাপতি জ্যোতিপাল মহাথেরোর নেতৃত্বে পাঁচজন বৌদ্ধ নেতা এক আবেদনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচারে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। অধিকাংশ বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করা হয়েছে এবং কুমিল্লায় ছয়জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা বিশ্ববাসীর কাছে গণহত্যার বিরুদ্ধে সহানুভূতি ও সমর্থন কামনা করেন।
ভারতের সমর্থন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সতর্ক করে দিয়ে বলেন, পাকিস্তান যদি ভারতের ওপর কোনো সংকট চাপিয়ে দেয়, তবে ভারত তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের ক্রমাগত আগমন এই অঞ্চলের শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভারতকে তার জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেন যে পূর্ব বাংলায় সবকিছু স্বাভাবিক। তিনি বলেন, যদি তা-ই হয়, তবে পাকিস্তানের উচিত ভারত থেকে সব শরণার্থীকে তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে নেওয়া।
প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) জানায়, ভারত পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে যে বাংলাদেশের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর এই সংকটের প্রভাব পড়ছে।
এদিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের পত্নী সমিতি বাংলাদেশ সহায়ক কমিটিকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার চেক প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের স্ত্রী উর্মিলা হাকসার এই চেকটি পদ্মজা নাইডুর হাতে তুলে দেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ বলেন, পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা উচিত। তিনি সিনেটে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, নির্বাচিত নেতাদের হত্যা ও পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে পাকিস্তানি জান্তা যে ভাবে উপেক্ষা করছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩০ লাখ শরণার্থীর ভারতে পালানোর খবর এবং পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সংকটের ভারতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, মানবিক কারণে সাহায্য দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তা পাকিস্তান সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে।
সুইডেনের দৈনিক ডিজেনস নাইটার এক সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানকে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করার আহ্বান জানায়। নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানে আইনের শাসন নেই এবং সেখানে চলমান হত্যাকাণ্ডের জন্য বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সংকট পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ। আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এর সমাধান সম্ভব নয়। ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
পাকিস্তান সরকার এই দিন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল, বিভাগীয় কমিশনার এবং কয়েকজন জেলা প্রশাসক ও এসপি-সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে। তাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর এক ও দুই)
পূর্বদেশ, ১৯ মে ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১৯ ও ২০ মে ১৯৭১
যুগান্তর (ভারত), ১৯ মে ১৯৭১
মন্তব্য করুন